নববধূ জোসনা রাণী আর কতো অপবাদ সইবে

 

 

শাহনেওয়াজ খান সুমন: বিয়ের আনন্দ, বাসর ঘর, বৌ-ভাত, স্বামীর বাড়ির আগমনের নতুন শুভেচ্ছা সবকিছু মিলিয়ে নতুন জীবন শুরু হবে নতুন একটি পরিবারের সদস্যদের সাথে। এমন স্বপ্ন মনের মধ্যে এঁকেছিলেন জোসনা রাণী। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাকে এমন বাস্তবতার মধ্যে ফেলে দেবে তা কে জানতো।

গত পয়লা আগস্ট শুক্রবারঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার সাঁকো মথুরাপুর গ্রামের সুবাস কুমারের বড় মেয়ে জোসনার সাথে বিয়ে হয়েছিলো শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরি গ্রামের সাধন কুমারের ছেলে তাপস কুমারের। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর ওই রাতেই কনে জোসনা রাণীকে নিয়ে বরপক্ষ রওনা হয়। রাত ৩টায় শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয় বরযাত্রীবাহী বাসটি। কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার নামক স্থানে চলন্ত ট্রেনের সাথে সংঘর্ষ হয় বরযাত্রীবাহী বাসটির। এতে ঘটনাস্থলে নিহত হয় ১১ জন। পরে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আরও একজন। আহত হয় প্রায় অর্ধশতাধিক। অন্য গাড়িতে থাকায় বেঁচে যান বর ও কনে।

এমন মর্মান্তিক ঘটনায় মুহূর্তেই যেন ফিকে হয়ে গেছে জোসনার জীবনের আলো। নতুন জীবন নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো এখন শুধুই দুঃসহ বেদনা। সব দোষ যেন তার একারই। এই ঘটনায় এলাকাবাসী ও আত্মীয় স্বজনেরা নববধূকেই দায়ী করছে। এরই মধ্যে এলাকায় বিভিন্ন গুজব উঠেছে যে, নববধূটি অলক্ষী, অপয়া, রাক্ষুসী, মৃত ১২ জনকে সেই গ্রাসকারী। এই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন জোসনা রাণী নিজেও। তবুও তাকে সহ্য করতে হচ্ছে অসহনীয় অপবাদ। এই দুর্ঘটনাই নববধূর স্বামীও ছিলো। কিন্তু তাকে কেউ দোষারোপ করছেন না। সবার নজর যেন নববধূর দিকে।

স্কুল শিক্ষিকা জোছনা রাণী, যে কি-না শিক্ষকতার মহান দায়িত্ব নিয়েছেন, সমাজে শিক্ষার আলো ছড়াবে, সমাজকে কুসংষ্কার মুক্ত করবে। সেই কুসংষ্কারের বেড়াজাল আজ তাকেই ঘিরে ধরেছে। এমন দুর্ঘটনায় সে নিজেও ভেঙে পড়েছে। কিন্তু সান্ত্বনা দেয়ার মতো পাশে নেই কেউ। অপবাদ সইতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন জোছনা রাণী।সারা জীবন দুঃসহ স্মৃতি বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে তাকে, স্বাভাবিক জীবন যাপন করার চেষ্টা করলেও ১২ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর কোনোভাবেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না। আমরা কি জানিনা জন্ম-মৃত্যু সবই সৃষ্টিকর্তার হাতে। তাহলে এই নিস্পাপ নববধূটির কী দোষ ছিলো?এটা তো তার স্বামীর দোষও হতে পারতো। তাহলে আমাদের সমাজ কোথায়?

আইনের চোখে এই ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য মূলত দোষী ছিলো ওই রেলক্রসিঙে দায়িত্বরত দুজন গেটম্যান মমিন ও হুমায়ুন। কিন্তু সমাজের মানুষের চোখ যেন আজও অশিক্ষা আর কুসংষ্কারের বেড়াজালে। আমরা এখনো কোনো খারাপ কিছুর জন্য নারীদের কেই দায়ী করি। আর এই জন্যই হয়তো নববধূকে শুনতে হচ্ছে অনেক অপবাদ। কিন্তু সমাজ ও শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলোর কাছে দায়ী শুধু সে-ই। ‘হাতের মেহেদী পাতার রং না শোকাতেই এভাবে চোখের অথৈই জ্বলে ভাসতে হবে আর শুনতে হবে নানান কটু-গঞ্জনা’ এমনটা জানলে হয়তো মেয়েকে বিয়েই দিতেন এমনটাই জানান মেয়ের বাবা সুবাস কুমার। এই ভাবেই হয়তো পার করতে হবে জোসনা রাণীর জীবনের বাকি দিনগুলো। এমন দুর্ঘটনা যেন আর কোনো জোসনার জীবনে না ঘটে, শুনতে যেন না হয় কোনো নারী কে এমন অপবাদ- এমনটাই প্রত্যাশা আমাদের সবার।