দেখা হবে স্বাধীন আরাকানে নয়তো জান্নাতে

গর্ভবতী স্ত্রীকে আরাকান যুবকের শেষ কথা

স্টাফ রিপোর্টার: মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর কয়েক দশক ধরে চলা নির্যাতনের পর এবার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেছে রোহিঙ্গারা। এতদিন নির্যাতন শুরু হলেই পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে চেষ্টা করতো রোহিঙ্গা নারী-পুরুষরা। কিন্তু সম্প্রতি রোহিঙ্গা পুরুষরা নারীদের নিরাপদ স্থানে রেখে সেনাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করছে। গত ২৫ আগস্ট ভোরে প্রায় ৩০টি পুলিশ ও সেনাঘাঁটিতে রোহিঙ্গারা হামলা চালায় বলে দাবি করে দেশটির সরকার। ওই হামলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তত ১২ জন সদস্য নিহত হয়। এর পর থেকে আরাকানে নতুন করে রোহিঙ্গা নির্যাতন শুরু হয়। ফলে সীমানা পেরিয়ে দলে দলে বাংলাদেশে আসতে শুরু করে রোহিঙ্গারা৷ তবে বরাবরের মতোই বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ফেরত পাঠাচ্ছে রোহিঙ্গাদের৷ ফলে নো ম্যানস ল্যান্ডে আটকা পড়েছেন শ’ শ’ রোহিঙ্গা৷ তবে এবার শরণার্থীদের ঢলে একটু পরিবর্তন দেখছেন বিজিবি সদস্যরাও৷ অন্যান্যবার পুরো পরিবারসহ রোহিঙ্গারা পালিয়ে এলেও এবার শরণার্থীদের দলে পুরুষদের সংখ্যা একেবারেই কম বলে জানিয়েছেন বিজিবি কর্মকর্তারা৷

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিজিবি কর্মকর্তা জানান, ‘পুরুষদের কী হয়েছে, আমরা তাদের (রোহিঙ্গা নারীদের) জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ আমাদের জানানো হয়েছে লড়াই করার জন্য পুরুষরা রয়ে গেছে।’ নতুন সহিংসতায় পালিয়ে আসাদের ভাগ্য সহায় না থাকলেও সন্তানসম্ভবা হওয়ায় আয়েশা বেগম স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশে কক্সবাজারের একটি ক্যাম্পে৷ তবে ষষ্ঠ সন্তানের জন্ম দেখতে পারছেন না তার স্বামী৷ রোহিঙ্গাদের হয়ে যুদ্ধ করার আহ্বানে সাড়া দিয়ে মিয়ানমারের রাখাইনেই রয়ে গেছেন তিনি৷ আয়েশার বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে এএফপির খবরে। আয়েশা বলেন, ‘আমাদের তিনি (আয়েশার স্বামী) নদী পাড়ে এনে বিদায় দিয়েছেন৷ বলেছেন, বেঁচে থাকলে দেখা হবে স্বাধীন আরাকানে, মারা গেলে দেখা হবে জান্নাতে।’ আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি (এআরএসএ)। অক্টোবর হামলার দায় স্বীকারের পর থেকেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পরিচিত হয়ে উঠেছে এআরএসএ৷ দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত নির্যাতনের শিকার হলেও সাধারণ রোহিঙ্গারা এতদিন প্রতিরোধ করেনি। কিন্তু গত বছরের অক্টোবরে এবং চলমান সেনা অভিযানের পর সাধারণ রোহিঙ্গারাও প্রতিরোধ করতে শুরু করেছে। মিয়ানমারে গত বছরের অক্টোবরে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন শুরু হয়৷ ফলে ৭০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

সীমান্তে আসা রোহিঙ্গা নেতা শাহ আলম জানান, আশেপাশের ৩ গ্রাম থেকে অন্তত ৩০ জন যুবক ‘স্বাধীনতার যুদ্ধে’ যোগ দিয়েছেন এআরএসএতে৷ তিনি বলেন, ‘তাদের কীইবা করার ছিলো! পশুর মতো খুন হওয়ার চেয়ে লড়াই করে মারা যাওয়ার পথ বেছে নিয়েছেন তারা৷’ তবে এখন বিশ্বজুড়ে এআরএসএকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পরিচিত করানোর উদ্যোগ নিয়েছে মিয়ানমার সরকার৷ কঠোর বিবৃতি এবং এআরএসএর গুলিতে নিহত বেসামরিক নাগরিকদের ছবি প্রকাশ করে বিশ্বে জনমত গড়ে তোলারও চেষ্টা চালাচ্ছে মিয়ানমার৷ পালটা প্রচার চালাচ্ছে এআরএসএ। শুধু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যেই নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের কাছেও পৌঁছে গেছে যুদ্ধের ডাক৷ হাজেরা বেগমের তিন ছেলেকে নিয়ে গত মাসে সীমানা অতিক্রম করে বাংলাদেশে এসেছেন৷ তার আরও দুই ছেলে রয়ে গেছেন যুদ্ধ করবেন বলে৷ বাংলাদেশে আসার এক সপ্তাহের মধ্যে তার আরেক ছেলেও যোগ দেন লড়াইয়ে৷ এএফপিকে ওই মা বলেন, ‘ওরা (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) আমাদের এমনিতেই মারবে৷ এরা (এআরএসএ) আমাদের অধিকারের জন্য লড়াই করছে৷ আমি আমার ছেলেদের পাঠিয়েছি স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে।’ রোহিঙ্গা ওই নারী বলেন, ‘আমি তাদের (সন্তানদের) উৎসর্গ করেছি, আরাকানের জন্য।’ এআরএসএ বিদ্রোহীদের ভারি অস্ত্র বলতে কিছুই নেই৷ এখন পর্যন্ত বিভিন্ন হামলায় ব্যবহার করা হয়েছে ছুরি, ঘরে তৈরি বোমা এবং আগ্নেয়াস্ত্র৷ ফলে মিয়ানমারের সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে কতটুকু টিকতে পারবে বিদ্রোহীরা, সে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। অথচ দমছে না রোহিঙ্গা যোদ্ধারা৷ সীমান্তে এক রোহিঙ্গা যোদ্ধা বলেন, ‘আমাদের শ’ শ’ যোদ্ধা পাহাড়ে অবস্থান নিয়েছে৷ আমরা আরাকানকে রক্ষায় শপথ নিয়েছি, সেটা চাকু এবং লাঠি দিয়ে হলেও আমরা (লড়াই) করবো। কুতুপালং ক্যাম্পে এক রোহিঙ্গা যুবকের মন্তব্য ছিলো এমন -আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে৷ আমাদের তরুণরাও চিন্তা করছেন যুদ্ধে যোগ দেয়ার৷ আমরা প্রতিজ্ঞা করেছি, প্রথম সুযোগেই আমরা সীমান্ত অতিক্রম করবো।