দেশের সব হাসপাতালে হচ্ছে আইসোলেশন ইউনিট

আগ্রহী বাংলাদেশিদের ফেরানোর প্রক্রীয়া শুরু হবে : চীনে মারা গেছেন ৮১ জন
স্টাফ রিপোর্টার: চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া নতুন (২০১৯-হঈড়ঠ) করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এরই অংশ হিসেবে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে, বিশেষ করে আটটি বিভাগের জেলা সদর ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে কমপক্ষে ৫ শয্যার আইসোলেশন ইউনিট চালু করা হচ্ছে। তিনটি বিমানবন্দর, দুটি সমুদ্রবন্দরসহ দেশের ২৪টি প্রবেশপথে নেয়া হয়েছে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। খোলা হয়েছে হেলথ ডেস্ক। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইতোমধ্যে চীন ফেরত ২ হাজার ৪৭০ জন যাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। এই ভাইরাস কোনোভাবেই যেন দেশে আসতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি এই নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে আজ সচিবালয়ে চীন ভ্রমণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি আন্তঃমন্ত্রনালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
২৬ জানুয়ারি রোববার রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা স্বাক্ষরিত এক পত্রে দেশের সব বিভাগীয় ও জেলা হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট স্থাপনের নির্দেশনা দেয়া হয়। সেখানে বলা হয়েছে, চীনের সংক্রমিত নতুন (২০১৯-হঈড়ঠ)

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখা দিয়েছে। এই ভাইরাস প্রতিরোধে এবং নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিটি হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত আবশ্যক। এরই অংশ হিসেবে সংক্রমিত রোগীদের সেবায় সব হাসপাতালে অক্সিজেন এবং অন্যান্য সুবিধাসহ ৫টি বিছানা সংবলিত আইসোলেন ইউনিট নির্দিষ্টকরণের জন্য অনুরোধ করা হল।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, দেশের সব হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট চালু করতে রোববার রাতেই নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সোমবার অধিদফতরের সম্মেলন কক্ষ থেকে বিভাগীয় পরিচালক ও সিভিল সার্জনদের করোনাভাইরাস প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে সব ধরনের নির্দেশনা দিয়েছি। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনীয় উপকরণ বিশেষ করে মাস্ক, টুপি, হ্যান্ড গ্লোবস, চশমা, অ্যাপ্রোন, রেইনকোর্ট ইত্যাদি প্রয়োজনমতো সংগ্রহে রাখতে বলেছি। দেশে নতুন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া না গেলেও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সম্ভাব্য সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, রোববার রাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে এই রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাঠানো হয়। আমরা দেরি না করে, সেগুলো সব সিভিল সার্জনদের এবং বিভাগীয় পরিচালকদের পাঠিয়েছি এবং ওইসব নির্দেশনা মেনে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের কর্মরত চিকিৎকদের প্রশিক্ষণ দিতে বলেছি। পাশাপাশি তিনটি বিমান, দুটি সমুদ্রবন্দরসহ দেশের ২৪টি প্রবেশপথে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ হেলথ ডেস্ক স্থাপনে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। স্থলবন্দরে আপাতত বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের হেলথ কার্ডের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ ও থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর পরিমাপের মাধ্যমে নজরদারিতে রাখতে বলা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (হেলথ ইমার্জেন্স অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম) ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, আজ (সোমবার) দুপুর ১২টা পর্যন্ত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানার ও হ্যান্ড স্ক্যানিং মেশিনের মাধ্যমে দুই হাজার ৪৭০ জন যাত্রীকে স্ক্যান করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত দেশে কোনো ২০১৯-হঈড়ঠ

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়নি।
এদিকে চীনে ভ্রমণ সংক্রান্ত কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে কিনা, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হবে আজ। এর আগে রোববার এ রোগ সংক্রান্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সভায় স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বৈঠক করতে মন্ত্রীকে পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ অনুসারে আজ দুপুর ১২টায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হবে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। চীন ও আশপাশের দেশ ছাড়া বাকি দেশ থেকে আসা যাত্রীরা এ পরীক্ষার আওতামুক্ত। যদিও শাহ আমানতে চীনের সরাসরি কোনো ফ্লাইট নেই। বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক উইং কমান্ডার সরওয়ার-ই-জামান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এদিকে এই ভাইরাস মোকাবেলায় সোমবার দুপুরে নগরীর টাইগারপাসস্থ সিটি মেয়র কার্যালয়ে জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
আগ্রহী বাংলাদেশিদের চীন থেকে ফেরানো হবে: চীনে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে সে দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সোমবার ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন, আগ্রহীদের দেশে ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চীন সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী লিখেন, ‘কি প্রক্রিয়ায় এটি করা হবে তা বাস্তবতার নিরিখে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সম্মতির ভিত্তিতে করা হবে। চীন থেকে দেশে ফিরতে আগ্রহীদের তালিকা করতে একটি প্রাথমিক নির্দেশনা জারি করা হবে। চীনের যে শহর থেকে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস ছড়িয়েছে সেই উহানেই ৩০০ থেকে ৪০০ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন বলে শনিবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। তবে এখনও বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস একটি হটলাইন চালু করেছে। শিক্ষার্থী ও গবেষকরা সপ্তাহের সাত দিন হটলাইনের +৮৬ ১৭৮-০১১১-৬০০৫ নম্বরে ফোন করে চব্বিশ ঘণ্টা সহায়তা নিতে পারবেন বলে জানানো হয় ওই বিজ্ঞপ্তিতে।
গুলশানের একটি হাসপাতালে চীনা নাগরিক ভর্তি: জ্বর ও কাশি নিয়ে রাজধানীর গুলশানের একটি হাসপাতালে সোমবার দুপুরে এক চীনা নাগরিক ভর্তি হয়েছেন। সম্ভাব্য নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত- এমন বিবেচনায় তাকে অন্য রোগীদের থেকে আলাদা রাখা হয়েছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক বলেন, ‘আমরা ওই রোগীর বিষয়ে শুনেছি। কিন্তু এখনও তার লালার নমুনা সংগ্রহ করা হয়নি। এই রোগের উপসর্গ অন্যান্য ভাইরাস জ্বরের মতোই। তাই এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। তাছাড়া সে রকমটি হয়ে থাকলে প্রতিরোধের প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে।’
করোনাভাইরাসে মৃত ৮১, আক্রান্ত পৌনে তিন হাজার: ৩১ ডিসেম্বর চীনের মধ্যাঞ্চলের উহান শহরে প্রথমবারের মতো প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্তের খবর আসে। এরপর এই ভাইরাস চীনের বিভিন্ন শহরের পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। চীনে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এখন পর্যন্ত দেশটিতে এই ভাইরাসে ৮০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া আরও দুই হাজার ৭৪৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন। রোববার পর্যন্ত এই সংখ্যাটি ছিলো ১৯৭৫ জন। চীনের গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, এই ভাইরাসে আক্রান্ত তিন শতাধিক মানুষ মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছে। চীনের হুবেই প্রদেশে ৫০ হাজারের বেশি মেডিকেল স্টাফ এই ভাইরাস প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসায় অংশ নিয়েছেন। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়া রোধে চন্দ্র নববর্ষের ছুটি বৃদ্ধি করেছে দেশটি। পাশাপাশি বেশকিছু বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে অথবা কর্মীদের বাসা থেকে কাজ করতে বলেছে সরকার।
চীনে এ ভাইরাসের সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৮১ জনে দাঁড়িয়েছে জানিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স সোমবার জানায়, চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং নতুন করোনাভাইরাসের উৎসস্থল হিসেবে চিহ্নিত মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশ হুবেইয়ের রাজধানী উহান পরিদর্শন করেছেন। প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে উহান পরিদর্শনে যাওয়া সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ নেতা লি। দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দুই হাজার ৭৪৪ জনে দাঁড়িয়েছে বলে সোমবার নিশ্চিত করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। আক্রান্তদের প্রায় অর্ধেক হুবেই প্রদেশের বাসিন্দা। ফ্লু-জাতীয় এই ভাইরাসটির সংক্রমণে হুবেইতে ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। মারা যাওয়া বাকি পাঁচজন চীনের অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দা। তাদের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপ প্রদেশ হাইনানের এক বাসিন্দা রয়েছেন। নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম একজনের মৃত্যুর কথা সোমবার নিশ্চিত করেছে প্রদেশটির কর্তৃপক্ষ।
এদিকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে চীন শাসিত হংকং আটজনের আক্রান্ত হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে। গত ১৪ দিনের মধ্যে যারা হুবেই গিয়েছেন তাদের হংকং প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে নগরটির স্থানীয় সরকার। তবে হংকংয়ের বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না। চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকে উৎপত্তি হওয়া করোনাভাইরাসটি ইতোমধ্যেই দেশটির রাজধানী বেইজিংসহ ২৯টি প্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। পাশপাশি এই ভাইরাস চীনের সীমানা ছাড়িয়ে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, নেপাল, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা পর্যন্ত গেছে।
ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে চীন সরকার নববর্ষের সপ্তাহব্যাপী ছুটি তিন দিন বাড়িয়ে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করেছে। নববর্ষের ছুটিতে চীনজুড়ে উৎসব ও ভ্রমণের ধুম পড়ে যায়। কোটি কোটি লোক ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। তবে ভাইরাসের আতঙ্কে এবার তাদের অনেকেই পরিকল্পনা বাতিল করে ঘরে বসে আছেন। সরকারও বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান বাতিল, সীমিত করে এবং ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। বিমান চলাচল, ট্রেন ও অন্যান্য গণপরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে উহান কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে আছে। চীনের অন্য কয়েকটি শহরেও চলাচলের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সোমবার থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত উহানের ভিসা ও পাসপোর্ট সেবা বন্ধ থাকবে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। তবে এসব বিধিনিষেধ সত্ত্বেও শহরটির এক কোটি ১০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ৫০ লাখ ছুটি ও অন্যান্য কারণে শহর ত্যাগ করেছে বলে নিশ্চিত করেছেন উহানের মেয়র।