মুমূর্ষু রোগীর আর্তনাদও ঝিনাইদহ হাসপাতালের চিকিৎসক মন গলায় না

নানা সঙ্কটে হাসপাতালটি এখন নিজেই রোগী

 

শাহনেওয়াজ খান সুমন: ১শ বেডের ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছেন ১৫০ জন রোগী। আর বর্হিবিভাগে চিকিৎসা নেন ৫শ জন। দিনের পর দিন এ হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও চিকিৎসক, শয্যা সংখ্যা ও ওষুধ বাড়ছে না। রোগীর চাপ, জনবল ও বেড সঙ্কটের মাঝে এভাবেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল। নানা সঙ্কটে হাসপাতালটি এখন নিজেই রোগী।

১৯৯৪ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে হাসপাতালটি ৫০ থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করার ঘোষণা দিলেও তা কার্যকর হয়নি। গত বছরের ৮ অক্টোবর সদর হাসপাতালটি ১০০ থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সরকারিভাবে ১শ বেডের খাবার, শয্যা ও ওষুধ সরবরাহ করা হলেও চিকিৎসার মূল ভরসা সেই ডাক্তার তথা জনবল নিয়োগ সম্ভব হয়নি ১৮ বছরেও। ফলে পদে পদে রোগীদের দুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অভিযোগ, সকাল ৮টায় অফিস সময় শুরু হয়ে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত চলার নিয়ম থাকলেও যথাসময়ে ডাক্তার আসেন না। দেরিতে এসে তারা আবার আগে-ভাগেই চলে যান বলে অভিযোগ। রোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিন হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন ডাক্তাররা আসেন ১০টার দিকে। এরপর তারা সম্মেলনকক্ষে কিছু সময় আড্ডা দিয়ে রোগী দেখতে বসেন। মেডিকেল অফিসাররা নিজ নিজ চেম্বার ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ভর্তি হওয়া রোগীদের দেখতে রাউন্ডে বের হন। রাউন্ড শেষ করে বেশির ভাগ সময় তাদের (বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক) চেম্বারে আসতে ১২টা গড়িয়ে যায়। এ দীর্ঘ সময়ে চেম্বারের বাইরে অপেক্ষমান মুমূর্ষু ও সাধারণ রোগীদের অবস্থার শেষ থাকে না।

ঝিনাইদহ শহরের আদর্শপাড়ার রিপন হোসেন নামের এক রোগী জানান, পাঁচ টাকা দিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কাটার পর রোগীর যন্ত্রণা ও হয়রানি আরও বেড়ে যায়। টিকিটের ওপর রুম নম্বর থাকায় ওই নম্বরযুক্ত কক্ষে বসা ডাক্তার ছাড়া আর কেউ রোগী দেখেন না। অন্য ডাক্তারকে দেখাতে হলে টিকিটরুম থেকে রেফার্ড করে আনতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল রোগীদের এ প্রক্রিয়া শেষ করতে হিমশিম খেতে হয়। এরপরও রয়েছে নার্স ও ডাক্তারদের অসৌজন্য আচরণ আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ঝামেলা।

কুলসুম বেগম নামে এক রোগী জানান, তিনি দাঁতের ডাক্তার দিয়ে দেখাবেন বলে পদ্মাকর ইউনিয়ন থেকে এসেছেন। কিন্তু দুপুর ১২টা বাজার পর আর টিকিট দেয়া হয় না। তিনি জানান, ডাক্তার রোগী দেখতে চাইলেও কাউন্টারে টিকিট বিক্রেতারা যেন বাঁশের চেয়ে কঞ্চি শক্তের মতো ক্ষমতা দেখান। ফলে এভাবে অনেক রোগী দূর-দূরান্ত থেকে এসে চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যান। অভিযোগ পাওয়া গেছে জহরের আজান শোনা মাত্রই দুপুর দেড়টার দিকে বেশির ভাগ ডাক্তার চেম্বার ছেড়ে বাড়ির পথ ধরেন। এ সময় কোনো মুমূর্ষু রোগীর আর্তনাদও তাদের মনকে বিন্দুমাত্র গলাতে পারে না।

হাসপাতালে আসা-যাওয়ার এ দৃশ্য প্রতিদিনের হলেও চিকিৎসকদের দেখভাল করার মতো কেউ নেই। কারণ হাসপাতালে স্থায়ী কোনো তত্ত্বাবধায়কের পদ নেই। সিভিল সার্জন অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে মাঝে মধ্যে বসেন। অভিযোগ আছে, রাতের বেলা জরুরি বিভাগ ছাড়া চিকিৎসক থাকেন না। নিয়ম আছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রাতে প্রতিদিন রাউন্ড দেবেন। কিন্তু তা তারা করেন না। মরে গেলেও রাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কোনো দেখা পান না রোগীরা।

সদর পোড়াহাটী গ্রামের আবদুস সামাদ নামে এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, হাসপাতালের জরুরিসহ বিভিন্ন বিভাগে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা কিছু লোক রোগীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন। জরুরি বিভাগ থেকে লাশ নামাতে হলেও স্বেচ্ছাসেবকদের খুশি করতে হয়। টুকিটাকি কাটা ছেড়া সেলাই করতে হলে তারা টাকা দাবি করে বসেন।

ঝিনাইদহ সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ১৮৯০ সালের দিকে শহরের ছবিঘর সিনেমা হলের পশ্চিম দিকে ব্রিটিশ আমলে ১০ শয্যার হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৭০ সালে হাসপাতালটি লোকালয় থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করে হামদহ এলাকায় প্রধান সড়কের পাশে স্থাপন করা হয়। হাসপাতালটি স্বাধীনতার পর ৪৩ বছর অতিবাহিত হলেও সেই সময়কার জনবল কাঠামো এখনও হাসপাতালে বিদ্যমান। মাত্র ১৬ জন চিকিৎসক দিয়ে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালটি চালানো হয়। তবে স্বাচিপ নেতাদের অনেকেই ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না বলে অভিযোগ। ডিউটি ফাঁকি দিয়ে তারা টিভি রুমে বসে থাকেন বলে অভিযোগ। আবার অনেকে বিনা ছুটিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। হাসপাতালের দন্ত বিশেষজ্ঞ ডা. চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস অধিকাংশ সময় হাসপাতালে থাকেন না। তার সহকারী বিউটি আক্তার ছবি চিকিৎসক সেজে রোগী দেখেন। চিকিৎসকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি রোগীদের সাথে দুর্ব্যবহার করেন। প্রতিদিন অফিস বাদ দিয়ে শহরের থানার সামনে নিজ চেম্বারে রোগী দেখেন তিনি। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কামাল হোসেন রোগীদের ঠিকমতো না দেখে ক্রিসেন্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাওয়ার পরামর্শ দেন। হাসপাতালে রোগী না দেখে তিনি ক্লিনিকে রোগী দেখেন। সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. মোজাম্মেল হোসেন হাসপাতালে রোগী দেখা বাদ দিয়ে ইসলামী কমিউনিটি হাসপাতালে রোগী দেখেন। ডা.জাহিদুর রহমান জেলার বিভিন্ন ক্লিনিকে ভাড়ায় রোগী অপারেশন করেন। তার নাম ভাঙিয়ে ক্লিনিক মালিকরা অপারেশন করেন। হাসপাতালে দায়িত্ব পালনের সময় ডা. মোকাররম হোসেনও রোগী দেখেন সমতা ডায়াগস্টিক সেন্টারে। বাইরের জেলা থেকে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হাসপাতালে এলে স্থানীয় চিকিৎসকরা তাকে এখানে থাকতে দেন না। আর স্বেচ্ছাসেবক সাগরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হাসপাতালের রোগীরা। আউটডোরে রোগীদের নিকট থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় ও দুর্ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আইয়ুব হোসেন জানান, আশপাশ জেলার সদর হাসপাতালগুলো আড়াইশ বেডে উন্নীত হলেও ঝিনাইদহ এক্ষেত্রে পিছিয়ে। প্রতিদিন রোগীর অত্যাধিক চাপে চিকিৎসকরা কাহিল হয়ে যাচ্ছেন। জরুরি কয়েকটি বিভাগে দীর্ঘদিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে ডা. আইয়ূব বলেন, আমাদের প্রমোশন নেই, সুযোগ সুবিধা নেই, পিয়ন নেই। ২৭ বছর সেই একই পদে পড়ে আছি। কিন্তু অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা তো আয়েশে দিন কাটান।

আবাসিক মেডিকেল অফিসার রাশেদ আল মামুন জানান, হাসপাতালে দীর্ঘদিন থেকে শিশু, নাক কান গলা, চক্ষু ও সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মেডিসিন বিশেষজ্ঞ নেই। তিনি আরও জানান, পরিস্থিতি সামাল দিতে ৯টি বিভাগে অন্তত ৪ জন করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দরকার। এক্ষেত্রে কেবল গাইনি, সার্জারি, হৃদরোগ, দন্ত ও হাড়জোড় বিভাগে চিকিৎসক আছে বলে জানান। তিনি জানান, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে প্রতিদিন অনেক গরিব রোগীকে বাইরে রেফার করতে হয়। এছাড়া হাসপাতাল থেকে রোগীদের ৪৫ আইটেমের ফ্রি ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে হৃদরোগ, ব্যাথা, গ্যাসস্ট্রিক, জ্বর, আমাশয় ছাড়া জটিল রোগের কোনো ওষুধ সরবরাহ নেই বলে জানা গেছে।

ঝিনাইদহ বিএমএ’র সভাপতি প্রবীণ চিকিৎসক ডা. আজিজুর রহমান জানান, আমরা হাসপাতালে একশ বেডের জনবল নিয়োগের জন্য মন্ত্রণালয়ে চেষ্টা করেও কাগজপত্রে এ দোষ সে দোষ দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। তিনি জানান, এভাবে একটি জেলা সদরের হাসপাতাল চলতে পারে না। রোগীর চাপ ও নানামুখি সঙ্কটে অনেক সময় চিকিৎসক ও নার্সদের মন-মানসিকতা ঠিক থাকেন। তাই প্রায় সময় দুর্ব্যবহার শুনতে হয় রোগীদের। তিনি জানান, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে রোগীরা সেবা পাচ্ছেন না।

ঝিনাইদহ সিভিল সার্জন ডা. নাসরিন সুলতানা জানান, জনবল নিয়োগের জন্য একাধিকবার মন্ত্রণালয়ে কাগজ পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কোনো সাড়া নেই। তিনি জানান, ১শ বেডের খাবার ও ওষুধ পাওয়া গেলেও অবকাঠামো ও জনবল ৫০ শয্যায় রয়ে গেছে। তিনি আরও জানান, হাসপাতালে যে জনবল আছে তাতে কিছুটা সামলানো যাচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ পূরণ হলে ভালো হতো। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মান ও যন্ত্রপাতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।