বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ শিক্ষক নজরদারিতে : চলছে চুলচিরা বিশ্লেষণ

 

স্টাফ রিপোর্টার: সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ শিক্ষকের জীবন-বৃত্তান্ত গোয়েন্দারা চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন। এই ২৫ শিক্ষক ১০ বছর আগে থেকে এই দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে জঙ্গিবাদের বীজ বপনের কাজটি করেছেন। ইসলাম ও ভূ-রাজনৈতিক ভিত্তিক বিভিন্ন সেমিনার অনুষ্ঠানের নামে ঐসব শিক্ষার্থীকে উপস্থিত করে মগজ ধোলাইয়ের কাজ করা হয়েছে। শিক্ষার নামে এই মগজ ধোলাইয়ের কাজটির মূল পরিকল্পনাকারী ড. রেজাউর রাজ্জাক। ২০১৩ সাল পর্যন্ত ড. রেজাউর রাজ্জাক ছিলেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির এমবিএ প্রোগ্রাম সমন্বয়ক। জঙ্গিবাদের সাথে তার সরাসরি যোগাযোগের বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থার নজরে এলে তিনি ওই ইউনিভার্সিটি থেকে লাপাত্তা হয়ে যান। দেশে ঘটে যাওয়া জঙ্গি হামলা ও টার্গেট কিলিংয়ের তিনি অন্যতম পরিকল্পনাকারী বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে। বর্তমানে ড. রেজাউর রাজ্জাক মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন বলে গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা।

গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে ধানমণ্ডির ৭ নম্বর রোডে রিসার্চ সেন্টার ফর ইউনিটি ডেভেলপমেন্ট (আরসিইউডি) নামে একটি এনজিও চালু করা হয়। তত্কালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ এই এনজিওটির অনুমোদন দিতে সহায়তা করেন বলে গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ছিলেন ড. আব্দুর রশিদ চৌধুরী। আরসিইউডিতে মূলত জামায়াতুল মুসলেমিন নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের প্রচারণা চালানো হতো। বিভিন্ন সময়ে ঢাকা সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক আরসিইউডিতে অনুষ্ঠিত সেমিনারে অংশ নেন। তালিকার মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, মানারাত ইন্টারন্যাশন ইউনিভার্সিটি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ। এসব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৮শ শিক্ষার্থী সেমিনারে অংশ নেন। এই সেমিনারকে হালাকা নামে অভিহিত করা হতো। সম্প্রতি ৱ্যাবের প্রকাশিত ২৬১ জনের তালিকা ও পরবর্তী হালনাগাদ করা ৭০ জনের তালিকায় স্থান পাওয়া উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই আরসিইউডির সেমিনারে অংশ নিয়েছিলেন। এই সেমিনারে দরিদ্র পরিবারের মেধাবী সন্তানদের তথাকথিত বৃত্তি প্রদানের নামে তাদের মগজ ধোলাই করা হতো। হিযবুত তাহরীরের সদস্যরাও এসব সেমিনারে অংশ নিতেন বলে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। জামায়াতুল মুসলেমিনের শেষ আমির ইজাজ হোসেন ২০০৮ সালে পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় আমেরিকান ড্রোন হামলায় নিহত হন। ইজাজের দুই ভাই বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রয়েছেন।

সূত্র জানায়, ড. রেজাউর রাজ্জাক ২০০১ সালে আমেরিকায় এফবিআইয়ের হাতে জঙ্গি সন্দেহে আটক হয়েছিলেন। আরসিইউডির চেয়ারম্যানের মেয়েকে বিয়ে করে তেহজীব করিম। এই তেহজীব করিম গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড। হলি আর্টিজানে হামলার আগে তেহজীব করিম বারিধারায় সপরিবারে বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। হামলার ৩ দিন পর ওই বাসা ছেড়ে দিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন। এর আগে তেহজীব করিম রাজধানীতে এক/দুই মাস পর পর করে ভাড়া বাসা পরিবর্তন করেছিলেন। তেহজীব করিমের ছোট ভাই রাজীব করিম ২০১০ সালে ব্রিটেনে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি বিমানে হামলার পরিকল্পনা করতে গিয়ে ধরা পড়েন। এ সময় তার এক বন্ধু কাজী মোহাম্মদ রেজোয়ানুল আহসান নাফিজ পালিয়ে যান। নাফিজ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। পরে আমেরিকায় পড়তে গিয়ে ২০১২ সালের ১৮ অক্টোবর নাফিজ গাড়ি বোমা হামলা চালানোর পরিকল্পনার অভিযোগে এফবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়ে ৩০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। রাজীব করিম ব্রিটেনের আদালতে ২০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে জেল খাটছেন।

সূত্র জানায়, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে নাফিজের বন্ধু ছিলেন কলাবাগানের রেজোয়ান শরীফ। এর আগে ধানমণ্ডিতে আরসিইউডির সেমিনারে তাদের সাথে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সেজাদ রউফ, তাজ-উল-ইসলাম রাশিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাহমিদ রহমান সাফি, ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির আরফান ইসলামসহ উত্তরাঞ্চলের দরিদ্র পরিবারের মেধাবী সন্তান, হিযবুত তাহরীরের মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ জিয়াউল হক ও আনসার আল ইসলামের (আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) জসিমুদ্দীন রাহামানীসহ কয়েকজন সদস্য বিভিন্ন সময়ের সেমিনারে অংশ নেন।

গোয়েন্দা সংস্থার এক তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ইসলামের নামে লাখ লাখ টাকা দেশে আনা হয়। এনজিওর মাধ্যমে এসব টাকা জঙ্গিবাদের পেছনে ব্যয় করা হয়। বিদেশ থেকে এই টাকা আনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ জন শিক্ষক সরাসরি মধ্যস্থতা করেছেন। সম্প্রতি হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর এই ২৫ শিক্ষকের জীবন-বৃত্তান্ত তদন্ত করছে। এদের মধ্যে বুয়েট, নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক রয়েছেন বেশি।