প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তি বাণিজ্যের টোপ!

 

স্টাফ রিপোর্টার: ৬৬ হাজার ৯৮৭ জন পরীক্ষার্থীর মধ্য থেকে ভর্তির লড়াইয়ে জয়ী হয়েছে মোট ২২ হাজার ৭৫৯ জন মেধাবী ছাত্রছাত্রী। সরকার ঘোষিত ভর্তিযোগ্য এসব মেধাবীর মধ্যে ১২ হাজার ৪৬০ জন শিক্ষার্থীর কপালে জুটছে না ডাক্তারি পড়া। মেধার লড়াইয়ে পাস করেও আসনের অভাবে তারা ভর্তির সুযোগ পাবে না কোনো সরকারি বা বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে। কারণ সর্বশেষ হিসাব অনুসারে দেশে সব মিলিয়ে এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে আসনসংখ্যা মাত্র ১০ হাজার ২৯৯। এর মধ্যে সরকারি কলেজে আসন সংখ্যা তিন হাজার ৬৯৪। বাকি ছয় হাজার ৬০৫টি আসন বেসরকারি কলেজে। এর বিপরীতে যোগ্য প্রার্থী থাকছে মোট ১৯ হাজার ৬৫ জন ছাত্রছাত্রী, যাদের টার্গেট করে ইতোমধ্যেই মাঠে নেমেছে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি বাণিজ্যে যুক্ত একটি চক্র।

গতকাল রোববার মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরপরই এ চক্রটি খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে এসব ছাত্রছাত্রীর। এক্ষেত্রে তারা আগেভাগেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো। এমনই ছাত্রছাত্রীদের আগাম আভাস দিয়েছিলো অনেকে, যাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের সাথে যুক্ত। বিশেষ করে যে পরীক্ষার্থী যে কোচিং সেন্টারে কোচিং করেছে বা যে শিক্ষকের কাছে পড়েছে ওই কোচিং সেন্টার বা ওই শিক্ষক গতকাল ফল প্রকাশের পরপরই তৎপর হয়ে ওঠেন। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে বিপুল টাকার ভর্তি বাণিজ্যের আশঙ্কা করছেন চিকিৎসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে প্রস্তুতি নিয়ে সরকারি মেডিকেল কলেজে সুযোগ না পেলেও শিক্ষার্থীরা যে কোনো মূল্যে বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে বেশির ভাগই টাকার খেলায় অংশ নেয়। তাই বিশেষজ্ঞদের মত, এহেন টাকার খেলা বন্ধে সরকারের উচিত মেডিকেলে ভর্তিব্যবস্থা সংস্কার করা। এছাড়া বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তির জন্য ফি আগেভাগেই নির্ধারণ করে দেয়ার তাগিদ দেয়া হয় বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু কোনো বারেই সরকারের তরফ থেকে এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত গুরুত্ব দেখা যায় না। এবারও এখন পর্যন্ত কোনো নীতিমালা চূড়ান্ত হয়নি।

স্বাস্থ্যপ্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে জানান, ১০ হাজার ২৯৯টি আসনের বিপরীতে এবার ২২ হাজার ৭৫৯ জন পরীক্ষার্থী পাস করেছে। পাসের হার ৩৪। এর মধ্যে সরকারি তিন হাজার ৬৯৪ আসনে ভর্তি চলবে ৩০ অক্টোবর থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত। সরকারি কলেজে ভর্তি শেষে শুরু হবে বেসরকারি পর্যায়ে ভর্তি প্রক্রিয়া। ক্লাস শুরু হবে আগামী বছর ১০ জানুয়ারি। সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির যোগ্যতা অর্জনকারীদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্কোরধারী পেয়েছে ১৮১ দশমিক ৫ (২০০ নম্বরের মধ্যে), আর সর্বনিম্ন ১৫৮ দশমিক ২৫।

প্রতিমন্ত্রী জানান, সরকারি কলেজগুলোর মধ্যে ছাত্রের (১৭৯১) চেয়ে ছাত্রীর (১৮৯৩) সংখ্যা বেশি। আর মোট পাস করা ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ছেলে ১১ হাজার ৪৪৬ ও মেয়ে ১১ হাজার ৩১৩ জন।

প্রাইভেটে বাণিজ্যের সুযোগ: বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তি ফি নিয়ে বাণিজ্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসচিব এমএম নিয়াজউদ্দিন বলেন, এখনো এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। সর্বোচ্চ ১৪-১৫ লাখের মতো ফি নির্ধারণ করা হতে পারে, যা শিগগিরই ঠিক করা হবে। তবে মন্ত্রণালয়ের অন্য একটি সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের এক সিদ্ধান্তে ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা করে ফি নির্ধারণের একটি আলোচনা হয়েছে। যদিও এর সাথে মাসিক বেতনসহ আরো কিছু বিষয় আলাদাভাবে আদায়ের সুযোগ চেয়েছে কলেজগুলো, যা নিয়ে ব্যয় প্রায় ২০ লাখ টাকায় উঠে যাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অভিভাবক গতকাল কাছে অভিযোগ করেন, কোনো কোনো কোচিং সেন্টারের লোকজন ফল প্রকাশের সাথে সাথে তা বিশ্লেষণ করে বের করে ফেলেছে কোনো শিক্ষার্থী সরকারি কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবে না। সে অনুসারে বঞ্চিতদের তালিকা সংগ্রহ করে ফোন করে বিভিন্ন আশ্বাস দেয়া শুরু করেছে তারা। কেউ কেউ প্রভাবশালী চিকিৎসক নেতাদের নাম ভাঙিয়ে সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ করে দেয়ারও প্রলোভন দেখায়। বেসরকারি কলেজের ক্ষেত্রে ২৫-৩০ লাখ টাকা দিলেই যেকোনো কলেজে ভর্তির সুযোগ করে দেয়ার কথাও শোনাচ্ছে কেউ কেউ। খুলনা থেকে ফোনে অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, স্কোর কম থাকায় হয়তো আমার সন্তান সরকারি মেডিকেলে সুযোগ পাবে না। কিন্তু বেসরকারি কলেজে ভর্তির সুযোগ থাকবে বলে মনে হয়। কিন্তু যেভাবে টাকার খেলার কথা শুনছি, বিভিন্ন পর্যায় থেকে দালালরা যেভাবে একেক অঙ্কের কথা বলছে তাতে এখনই বিভ্রান্তিতে পড়ে গেছি। সরকারের উচিত এ দিকটায় কঠোর নজরদারি দেওয়া, নয়তো অনেকেই প্রতারিত হতে পারেন।

আরেক অভিভাবক বলেন, ২০-৩০ লাখ টাকা খরচ করে ছেলেকে বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তির মতো সক্ষমতা আমার নেই। আর মেডিকেল কলেজগুলো কেনই বা এতো টাকা করে ফি আদায় করবে, মাথায় ধরছে না!

অনুমোদন বাতিলকৃত কলেজগুলোর তোড়জোড়: এদিকে গত বছর অনুমোদন বাতিলকৃত ১২টি বেসরকারি মেডিকেল ও একটি ডেন্টাল কলেজে ভেতরে ভেতরে ছাত্রছাত্রী ভর্তির আগাম প্রস্তুতি শুরু করেছে বলে জানা যায়। এসব কলেজের অনেক কর্মকর্তা ও মালিকপক্ষের অনেককে মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তৎপর দেখা যায় কয়েক দিন ধরেই। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী এ বিষয়ে বলেন, অনুমোদন বাতিলকৃত কলেজগুলোর বিষয়ে তদন্ত শেষ হয়েছে। তবে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। হয়তো শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত পাওয়া যেতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, অনুমোদন বাতিল হওয়া কলেজগুলোর পক্ষে বিভিন্ন পর্যায় থেকে তদবির করা হচ্ছে। মন্ত্রী থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা পর্যন্ত তাদের তদবিরে অতিষ্ঠ। একপর্যায়ে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে অবহিত করা হয়। ফলে অনুমোদনের বিষয়টি এখন অনেকটাই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ওপর নির্ভর করছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, অনুমোদন ফিরে না পাওয়া কলেজগুলোর তালিকায় রয়েছে ঢাকার মোহাম্মদপুরের কেয়ার মেডিকেল কলেজ, রংপুরের কাছির উদ্দিন মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ, খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ, খুলনার আকিজ আদ দ্বীন মেডিকেল কলেজ, সিলেটের পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রামের পোর্ট সিটি মেডিকেল কলেজ, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজ, রাজশাহীর শাহ মাখদুম মেডিকেল কলেজ, ঢাকার গুলশানের ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ, মহাখালীর ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজসহ ঢাকার উত্তরার এইএস ডেন্টাল কলেজ, চট্টগ্রামের আইআইএমসিএইচ মেডিকেল কলেজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ।

পাস করেও ভর্তির সুযোগ না পাওয়া ১২ হাজার ছাত্রছাত্রীর ভাগ্যে কী হবে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক এবিএম হান্নান বলেন, সরকারি মেডিকেল ভর্তিবঞ্চিত ১৯ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে বড় একটি অংশই প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তির আর্থিক ক্ষমতা রাখে না। এমনকি অনেক কলেজে আসন খালিও থাকে। প্রাইভেটে ভর্তি ফি দিতে না পারার ভয়ে নিজেদের থেকেই অনেকে অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলে যাবে। ফলে ছয় হাজার ছাত্রছাত্রী খুঁজে পেতেই কষ্ট হবে। তাই অসাধুচক্র টোপে ফেলেও সবার ক্ষেত্রে সুবিধা করতে পারবে না। তবু আমরা সতর্ক আছি। বরাবরই এমন চক্রের তৎপরতা দেখা যায়। সরকারের তরফ থেকে যথাসাধ্য ভর্তি-বাণিজ্যরোধে পদক্ষেপ নেয়া হবে।