দু শতাধিক চিকিৎসকের ব্যাংক হিসাব তলব

 

স্টাফ রিপোর্টার: শতাধিক খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রকৃত আয় গোপন করে বড় অংকের কর ফাঁকি দেয়ার সন্দেহে তাদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়। এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) ইতোমধ্যেই ৫৩৭ চিকিৎসকের তালিকা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চল থেকে প্রত্যেকের আয়কর নথি সংগ্রহ করেছে।

প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশের নামি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ৯০ শতাংশই প্রকৃত আয় গোপন করে মোটা অংকের কর ফাঁকি দিচ্ছেন। জমি, ফ্ল্যাট, বাড়ি, গাড়ি আর দেশে-বিদেশে বিশাল অঙ্কের সঞ্চয় থাকলেও তা গোপন করা হচ্ছে। এনবিআরের চেয়ারম্যানের নির্দেশে গত ২০ দিনে বিভিন্ন পর্যায়ের সিনিয়র চিকিৎসকদের ব্যাংক হিসাব তলব শুরু করেছে সিআইসি। প্রতিদিনই বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গোপনীয় চিঠি যাচ্ছে। এতে ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ব্যাংকিং লেনেদেনের বিস্তারিত তথ্য চেয়ে সময় দেয়া হচ্ছে মাত্র ৭ দিন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, প্রাথমিক অনুসন্ধানে এমন সব চিকিৎসকের কর ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে যারা দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ। এখন আইনি পদক্ষেপ নেয়ার আগেই জরিমানাসহ ফাঁকি দেয়া সব কর পরিশোধ করতে আয়কর বিভাগের কাছে অনেকে ধরনা দিচ্ছেন। আইন অনুযায়ী তাদের কর নথি পুনঃউন্মোচিত হবে। কর ফাঁকির জন্য ৩০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা করা হবে। একই সাথে চলবে কর মামলা। প্রয়োজনে ব্যাংক হিসাব জব্দ করেও আয়কর আইনে অর্থ আদায়ের সুযোগ আছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের প্রখ্যাত এক কার্ডিয়াক সার্জন রাজধানীর তিনটি নামি হাসপাতালে রোগী দেখেন। কমপক্ষে দু মাস আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করলে তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। দিনে গড়ে ৫ থেকে ৭ জন জটিল হৃদরোগীর অপারেশন করেন। শুধু অপারেশন করেই দৈনিক গড় আয় দেড় লাখ টাকার বেশি। এরপর আছে বেতন আর রোগী দেখার ফি। আরও আছে বিভিন্ন প্যাথোলজি ক্লিনিক থেকে আসা মাসিক কমিশন। সব মিলিয়ে দিনের আয় কমপক্ষে সোয়া দু লাখ টাকা। মাসেই যার আয় কমপক্ষে ৬০ থেকে ৭৫ লক্ষাধিক টাকা। অথচ এই নামি সার্জন বছরে আয় দেখাচ্ছেন মাত্র ৬৮ থেকে ৭১ লাখ টাকা। অর্থাৎ এ চিকিৎসক বছরে আয় গোপন করছেন কমপক্ষে ৮ কোটি টাকার বেশি। তার স্ত্রীও একটি নামি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তার আয়ও কয়েক কোটি টাকা। এখন এ চিকিৎসক দম্পতির ব্যাংক লেনদেন তলব করে অর্ধশত কোটি টাকা আয় গোপনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ধরনের আয় গোপন করা চিকিৎসকের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে সন্দেহ এনবিআরের।

এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন সম্প্রতি বলেছেন, প্রাথমিকভাবে ৫০০ চিকিৎসককে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে উপযুক্ত কর আদায় করেই তারা বসে থাকবেন না। নতুন নতুন তালিকা তৈরি করে চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সবার কাছ থেকেই উপযুক্ত কর আদায়ের উদ্যোগ নেয়া হবে। তিনি জানান, শুধু ডাক্তারই নন, বিপুলসংখ্যক খ্যাতনামা আইনজীবী বিশাল অংকের কর ফাঁকি দেন। শিগগিরই তাদের তালিকাও তৈরি করা হবে। একই সাথে কর ফাঁকিতে সহায়তাকারী আয়করের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

সিআইসি থেকে পাঠানো চিঠিতে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্রোকারেজ হাউসকে এ বলে সতর্ক করা হয়েছে যে, উপযুক্ত কারণ ছাড়া ছক অনুযায়ী হিসাবধারীর পূর্ণাঙ্গ তথ্যাবলী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরবরাহ করা না হলে আয়কর অধ্যাদেশের ধারা ১২৪(২) অনুযায়ী এককালীন ২৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং পরবর্তীতে প্রতিদিনের জন্যে ৫০০ টাকা হারে জরিমানা আরোপ করা হবে। একই সাথে ১৬৪ সিসি ধারায় অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ড আরোপের লক্ষ্যে ফৌজদারি মামলা করা হতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে।

বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জে পাঠানো সিআইসির গোপনীয় পত্রে ২০০৭ সালের ১ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত সব ধরনের ব্যাংক হিসাব বিবরণী ৭ দিনের মধ্যে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশের ধারা ১১৩ (এফ) অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের একক বা যৌথ নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এফডিআর ও এসটিডিসহ যে কোনো মেয়াদি আমানতের হিসাব, যে কোনো ধরনের বা মেয়াদের সঞ্চয়ী হিসাব, চলতি হিসাব, ঋণ হিসাব, ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্ট, ক্রেডিট কার্ড বা ডেবিট কার্ড হিসাব, ভল্ট, সঞ্চয়পত্র বা যে কোনো সেভিংস ইন্সট্রুমেন্ট হিসাবসহ আগে ছিলো কিন্তু বর্তমানে বন্ধ আছে এমন সব হিসাবের বিস্তারিত বিবরণী নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী পাঠাতে বলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, যেসব চিকিৎসক দিনে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা থেকে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করেন- এমন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দিকেই নজর বেশি এনবিআরের। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, সিলেটসহ ঢাকার আশপাশে যেসব নামি চিকিৎসক আছেন তাদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৫৩৭ জনের তালিকা করা হয়েছে। এদের সবাই সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকসহ নিজস্ব ক্লিনিক বা চেম্বারে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন। নির্ধারিত বেতন ছাড়াও একজন চিকিৎসকের বহুমুখি আয় ও কমিশন আছে। কিন্তু এসব আয়ের কিছুই কর নথিতে উল্লেখ নেই। তারা প্রতি বছর যে আয়কর রিটার্ন জমা দেন তাতে আয়ের প্রকৃত তথ্য গোপন করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কম আয় প্রদর্শন করে কর ফাঁকির আশ্রয় নিচ্ছেন প্রায় সবাই। কর ফাঁকিবাজ এসব ডাক্তারের বেশির ভাগের বসবাস ঢাকা ও চট্টগ্রামে হলেও দেশের অন্যান্য বিভাগ ও জেলা শহরেও এদের সংখ্যা কম নয় বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।

চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে, বেশির ভাগ কর ফাঁকিবাজ চিকিৎসক নিজ নামে অর্থসম্পদ না করে বেনামে স্ত্রী, পুত্র-কন্যা ও শ্যালকসহ নিকটাত্মীয়দের নামে করেছেন। ব্যাংক হিসাবের লেনদেনের সূত্র ধরে তাদেরও কর ফাঁকি অনুসন্ধান করা হচ্ছে। অনেক চিকিৎসকই সম্মানহানির ভয়ে আয়কর বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে প্রকৃত আয় দেখাতে চাচ্ছেন। তাদের ওপর নির্ধারিত জরিমানা আরোপ করে যথাযথ কর আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এনবিআরের পক্ষ থেকে। দেশের সব কর অঞ্চলকেই নিজ নিজ এলাকায় চিকিৎসকদের কর ফাঁকি ধরতে সাঁড়াশি তৎপরতার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র স্বীকার করেছেন এমন অনেক চিকিৎসক আছেন যারা প্রকৃত আয় প্রদর্শন করে কর দিচ্ছেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা হাতেগোনা। শতকরা ১০ ভাগের মতো চিকিৎসক বছরে ৩০ লাখ থেকে কোটি টাকা কর দেন। এমনও দেখা গেছে, একটি হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান বা প্রফেসর পর্যায়ের চিকিৎসক যে আয় ঘোষণা করে কর দেন অনেক ক্ষেত্রেই তার চেয়ে অনেক বেশি কর দিচ্ছেন একই বিভাগের জুনিয়র চিকিৎসক।

সিআইসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদেও দৈনন্দিন আয় অনুযায়ী বার্ষিক কর যা হওয়া উচিত তার ১০ শতাংশও দিচ্ছেন না। অনেকেই আবার উপযুক্ত করের ৫ থেকে ৭ শতাংশ দিয়েই দায় সারছেন। ফাঁকিবাজ এসব ডাক্তারের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট হারে কর আদায় করা গেলে সে অংক শত কোটি টাকার ঘর ছাড়িয়ে যাবে।

প্রশ্ন উঠেছে, আয়কর কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া বছরের পর বছর ধরে এভাবে কর ফাঁকি দেয়া সম্ভব কিনা। হাজার হাজার চিকিৎসক মাসে কয়েক লাখ টাকা আয় করলেও কর কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই তারা কর ফাঁকির সুযোগ নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এনবিআরের চেয়ারম্যানের নির্দেশে গত মাসে প্রথমবারের নামিদামি চিকিৎসকের তালিকা করে সিআইসি। সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চল থেকে এসব চিকিৎসকের নথি তলব করে তা পরীক্ষা করা হয়। এখনও শ শ কর নথি পরীক্ষা করা হচ্ছে। এতে দেখা গেছে, অধিকাংশ চিকিৎসকই প্রকৃত আয় গোপন করছেন। তাদের ব্যাংক হিসাব, এফডিআর, জমি-ফ্ল্যাট আর বিভিন্ন বিনিয়োগ তথ্য পেয়ে চমকে উঠেছেন সিআইসির কর্মকর্তারা। যেসব চিকিৎসক কমপক্ষে ১ হাজার টাকা রোগীপ্রতি ফি নেন। তারা যদি দিনে কমপক্ষে ৩০ জন রোগী দেখেন তাহলেও রোগী ফি হিসেবে ৩০ হাজার টাকা আয় হওয়ার কথা। এরপর রয়েছে অন্যান্য আয় ও নানা কমিশনের অর্থ। কিন্তু এসব নামি চিকিৎসক যে আয় দেখাচ্ছেন তাতে তাদের প্রতিদিনের আয় ১ হাজার টাকারও কম বলে সূত্র দাবি করেছে।