দায় এড়াতে পারে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

ব্যক্তি নিখোঁজের ঘটনায় হাইকোর্টে পিবিআই’র প্রতিবেদন

স্টাফ রিপোর্টার: কোনো নাগরিক নিখোঁজের অভিযোগ অস্বীকার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার দায় এড়াতে পারে না মর্মে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গতকাল রোববার দাখিল করা এই সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদনে পিবিআই বলেছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক কাউকে গ্রেফতার করা হলে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর কর্তব্য যথাসময়ে তাকে আদালতে উপস্থাপন করা। আর নিখোঁজের এ কাজটি কোনো অপরাধী চক্রের হলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব আরও বেশি। যাতে ভিকটিম ও অপরাধী চক্র উভয়কে খুঁজে বের করে আদালতে উপস্থাপন করার দায়িত্ব এ বাহিনীর। হাইকোর্টের নির্দেশে হোমিও চিকিত্সক সাতক্ষীরার কুখরালীর অধিবাসী শেখ মোকলেসুর রহমান জনি নিখোঁজের ঘটনা অনুসন্ধান করে পিবিআই।

ওই অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো মানুষ নিখোঁজ কিংবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে কোনো অপরাধী চক্র কর্তৃক আটক হবার অভিযোগ উত্থাপিত হলে সাধারণত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যে তিনটি বিষয় গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়ে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন তা হলো (১) আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে কোনো অপরাধীচক্র অপরাধ সংঘটন করেছে কিনা (২) অভিযোগটি বানোয়াট নাকি কাউকে ফাঁসানোর জন্য মিথ্যা ঘটনা (৩) আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা একটি প্রতিবেদনে বলেছে, সাধারণত এ জাতীয় অভিযোগ উত্থাপিত হলে প্রথমে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ হতে তার দায় অস্বীকার করা হয়ে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেবল এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেই কি তার দায় এড়াতে পারে? উত্তর হলো-না। তবে এ ধরনের নিখোঁজের অভিযোগ মিথ্যা কিংবা বানোয়াট হলে তা প্রমাণ করার দায়িত্বও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর বর্তায়। তাই এ ধরনের (জনি) নিখোঁজ কিংবা অভিযোগের ক্ষেত্রে কোন মামলা বা জিডি না নেয়ার মাধ্যমে সাতক্ষীরা সদর থানা পুলিশ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে চরম অদক্ষতা এবং অবহেলার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। যা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য মোটেই কাম্য নয়।

বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে গতকাল এই প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। মঙ্গলবার হাইকোর্ট এ বিষয়ের উপর আদেশ দিবে বলে জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তাপস কুমার বিশ্বাস।

পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার্বিক অনুসন্ধানে ও থানার রেকর্ডপত্র (জিডি ও হাজত রেজিস্টার) সহ দালিলিক সাক্ষ্য এবং সাক্ষীদের জবানবন্দি পর্যালোচনায় গত ৪ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে জনি নামের কোন ব্যক্তিকে সাতক্ষীরা থানা পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার পূর্বক আটক রাখা এবং পরবর্তী সময়ে নিখোজ হওয়া সম্পর্কে এমন কোনো তথ্য বা সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মৌখিক সাক্ষ্য অনুযায়ী ভিকটিমকে এসআই হিমেল কর্তৃক থানায় আনার বিষয়টি প্রকাশিত হলেও এ সকল সাক্ষীরা হলো অভিযোগকারী কর্তৃক উপস্থাপিত সাক্ষী। কোনো নিরপেক্ষ সাক্ষী দ্বারা থানায় আনার বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি। থানায় রক্ষিত সকল রেজিস্টার পর্যালোচনাকালেও থানা হেফাজতে ভিকটিমকে রাখার বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায় না। ফলে ওই এসআই হিমেল কর্তৃক ভিকটিমকে গ্রেপ্তারপূর্বক থানা হেফাজতে রাখার বিষয়টি অস্পষ্ট। ফলে জনি নিখোজের ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত না-কি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে কোন অপরাধীচক্র এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা প্রমাণ করা যায়নি। সদর থানার তত্কালীন ওসি মো. এমদাদুল হক শেখ এর পরবর্তী ওসি ফিরোজ হোসেন মোল্লা তার সময়কালে অভিযোগের বিষয়ে কোন আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় নিখোজ জনির প্রকৃত অবস্থান জানার আরও একটি সুযোগ নষ্ট হয়েছে মর্মে কমিটির নিকট অনুমেয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য কর্ম (মামলা/জিডি/তদন্ত/অনুসন্ধানকরনসহ) যথাযথভাবে পালন না করায় আজ অবধি নিখোঁজ হওয়ার প্রকৃত ঘটনাটি যেমনিভাবে উদঘাটিত হয়নি তেমনিভাবে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি মারাত্নকভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। ফলে উক্ত ঘটনায় সদও থানা পুলিশের যেসব সদস্য দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে চরম অদক্ষতা এবং অবহেলা করেছে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা যেতে পারে। পুলিশ ও বিচারিক তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে জনির সুস্পষ্ট অবস্থান নির্ণয়ের বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে না পারায় হাইকোর্ট গত বছরের অক্টোবর মাসে পিবিআইকে দিয়ে ঘটনাটি তদন্তের জন্য পুলিশের আইজিকে নির্দেশ দেয়। ওই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে পিবিআইয়ের (খুলনা বিভাগ) বিশেষ পুলিশ সুপার নওরোজ হাসান তালুকদারকে প্রধান এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিছুর রহমান ও মো. আব্দুল মতিনকে সদস্য করে তিন সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি দীর্ঘ অনুসন্ধানকালে দালিলিক সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে থানা হাজত রেজিস্ট্রার, জিডি বই, কমান্ড সার্টিফিকেট (সিসি), জিআর গ্রেফতারি পরোয়ানা রেজিস্ট্রারসহ থানার সংশ্লিষ্ট সকল রেজিস্ট্রারসূমহ পর্যালোচনা করে। পাশাপাশি বক্তব্য গ্রহণ করে সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার, সদর থানার ওসিসহ ৩৫ জনের।

মোকলেসুর রহমান জনির খোঁজ না পেয়ে তার স্ত্রী জেসমিন নাহার হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস ব্যক্তির অবস্থান নির্ণয় রিট করেন। রিটে বলা হয়, ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট রাত ৯টার দিকে ওষুধ আনতে বাড়ি থেকে বের হয়ে সাতক্ষীরা নিউ মার্কেট এলাকায় এলে জনিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওইদিন রাত ১টায় পুলিশ জনিদের বাড়িতে অভিযান চালায়। পরদিন জেসমিন ও তার শ্বশুর থানায় গিয়ে জনির খোঁজ করেন ও তাকে থানা হাজতে দেখতে পান। পরে আরো দুইদিন থানায় আটক থাকা জনিকে খাবারও দেন। ৮ আগস্ট থানায় গেলে পুলিশ জনিকে আটক করা এবং থানায় রাখার কথা অস্বীকার করে।