দর-কষাকষির শীর্ষে জামায়াতে ইসলামী

স্টাফ রিপোর্টার: রাজনৈতিক অঙ্গনে হঠাৎ করেই ইসলামী দলগুলোর কদর বেড়েছে। এরই মধ্যে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজ নিজ জোটে ভেড়াতে নানামুখী দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। নিজেদের গুরুত্ব আঁচ করতে পেরে হেফাজত-জামায়াতসহ সরকারের পক্ষ-বিপক্ষের ইসলামী দলগুলোও লাভ-লোকশানের হিসেব কষছে।

এদিকে কদর বাড়ানোর তালিকায় ব্যানার সর্বস্ব দলগুলোর নাম থাকলেও এ প্রতিযোগিতায় জামায়াতে ইসলামী সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। আর ইসলামী দলগুলোকে নিজেদের পক্ষে আনতে নানা ধরনের প্রলোভন দেখানোর পাল্লায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি শীর্ষে রয়েছে।

রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, বিএনপি এতদিন জামায়াতকে নিজেদের পকেট সংগঠন মনে করলেও অন্য দলগুলো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরুর পর তারা এখন জামায়াতকে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে। আগামীতে জামায়াতের ভূমিকা কি হবে এ নিয়ে এরই মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীও বলেছেন, হেফাজতে ইসলামের পর স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতের সঙ্গেও আওয়ামী লীগ আলোচনায় বসবে।

একটি সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই জামায়াতকে নানাভাবে বশে আনার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। তবে মৌলবাদী এ দলটি এতদিন তাতে সাড়া দেয়নি। এ বিষয়টি নিয়ে বিএনপিও দো-টানায় ছিলো। তাই জামায়াতের সাথে দূরত্বও বেড়েছে তাদের। সবশেষ হেফাজতের সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক উন্নয়নে চিন্তিত হয়ে পড়ে বিএনপি। তাই জামায়াতকে বেশ গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করছে তারা।  তবে আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতের যোগাযোগের বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, এ ধরনের সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপি ও তাদের অনুসারিরা দিশাহারা হয়ে গেছে, কে কি বলছে তারা নিজেরাও জানে না।

এদিকে একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় পার্টি জামায়াতের সাথে সখ্য গড়ে তুলতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিএনপির চাইতে বেশি গুরুত্ব ও সুবিধা দেয়ার কথাও বলা হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে। প্রয়োজনে জামায়াতের প্রার্থীকে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করতে দেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হবে বলেও সূত্রটি দাবি করে।

অন্য একটি সূত্র জানায়, জাতীয় পার্টির এই আশ্বাসে বিএনপির সাথে জামায়াতের দর কষাকষি বেড়ে গেছে। বিএনপি যদি নির্বাচনে যায় তাহলে ধানের শীষ প্রতীকে দলটি অন্তত ৭০টি আসনে নির্বাচন করার দাবি করছে। জামায়াতের গুরুত্ব বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে দলটির সুশৃঙ্খল নেতাকর্মী, ভোটব্যাংক, সারাদেশের নেটওয়ার্ক আছে।
সূত্রটি আরও জানায়, যদি বিএনপি বেশি আসনে নির্বাচনে প্রার্থিতার সুযোগ না দেয় তাহলে কিছু আসনে জামায়াতের প্রার্থীরা লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবে। দলটির লক্ষ্য যেভাবেই হোক সংসদে তাদের উপস্থিতি বাড়ানো।
দলটি মনে করছে, সংসদে দুই একটি আসনের প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো ক্ষমতার স্বাদ নিয়ে দলকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। এই দলগুলো দুই আসন থেকে এখন ২০টি আসনে নির্বাচন করার পরিকল্পনা করছে। তাই যেভাবেই হোক সংসদে প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে স্থানীয় সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য।
এ বিষয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের দপ্তর সম্পাদক তালহা যুবাইর যায়যায়দিনকে বলেন, তাদের সংগঠন প্রত্যেক জায়গায় শক্তিশালী। কিন্তু জনপ্রতিনিধিত্ব না থাকায় জনভিত্তি তৈরি হচ্ছে না। সংগঠনের পরিকল্পনা আগামীতে সেভাবেই হোক সংসদ থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি বাড়াতে হবে। এদিকে বিগত সময়ের চাইতে অনেক ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে ছোটখাটো ইসলামী দলগুলো। তারা নিজেরাও বুঝতে পারেনি নির্বাচনের দুই বছর আগে হঠাৎ তাদের কদর এত বেড়ে যাবে। তাছাড়া আওয়ামী লীগ তাদের বিরোধী ও বিএনপিপন্থি ইসলামী দলগুলোর প্রতি আগ্রহ দেখাবে তা ছিল চিন্তার বাইরে। তাই সরকারের তরফ থেকে হেফাজতের দাবি মেনে নেয়া ও তাদের সাথে এক রকমের সমঝোতার আভাস পাওয়ায় সবকটি ইসলামী দল নতুন করে নিজেদের গোছগাছ শুরু করেছে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে সবগুলো কমিটি সক্রিয় করার চেষ্টা করছে। একই সাথে নিজেদের শক্ত অবস্থান জানান দেয়ার চেষ্টা করছে। তারা এটাও বুঝানোর চেষ্টা করছে হেফাজত সব কওমি আলেমদের প্রতিনিধিত্ব করে না।
সূত্র আরও জানায়, রাজনীতির অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায় ছিল না ইসলামী দলগুলো। তাছাড়া বেশিরভাগ দল বিভিন্ন সময় ভাঙনের কারণে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল। বিএনপির সঙ্গে বড় ইসলামী দলগুলোর সম্পর্ক ভালো থাকলেও নিজেদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে না পারা ও দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে এই দলগুলোর প্রতি তারা সেভাবে কোনো নজর দিতে পারেনি। ফলে সম্পর্ক উপরে উপরে ভালো থাকলেও ভেতরে ভেতরে দূরত্ব অনেক বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় জাতীয় পার্টি এই সুযোগ কাজে লাগাতে চায়। সবগুলো ইসলামী দলের সঙ্গেই গোপনে যোগাযোগ শুরু করে দলটি। সর্বশেষ দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ইসলামী দলগুলোর নেতৃত্ব দেয়ারও কথা বলেছেন।

এদিকে সরকারের তরফ থেকে তাদের কট্টরবিরোধী হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কারণে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির হিসেবে কিছুটা ঝামেলা হয়ে গেছে। হেফাজতসহ কয়েকটি ইসলামী দলকে কিছু না দিলেও তারা বাধ্য হয়েই বিএনপিকে সমর্থন দিবে এমন ধারণা থেকে সরে এসেছে। এছাড়া জাতীয় পার্টি ২০টি ইসলামী দলকে নিয়ে যে জোট করতে যাচ্ছিলো তা হঠাৎ দর কষাকষিতে আটকে গেছে। তাই ইসলামী দলগুলোতে কাছে পেতে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি মরিয়া চেষ্টা করছে। এ সুযোগে প্রত্যেকটি দলই তাদের দর বাড়িয়ে দিয়েছে। যে দল আগে দুইটি আসনের প্রার্থী দেয়ার জন্য বড় দলের কাছে আশা করতো তারা এখন ১৫টি আসনের জন্য দর কষাকষি করছে। এছাড়া এককভাবে গুরুত্ব কম থাকবে বিধায় কয়েকটি দল একত্র হয়ে বড় দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে আলাপ আলোচনা শুরু করার চেষ্টা করছে।

জানা যায়, আওয়ামীপন্থি ইসলামী দলগুলোকে গোছানোর চেষ্টা করছে জোটের শরিক দল তরিকত ফেডারেশন। এরমধ্যে তারা অনেক কাজ গুছিয়ে এনেছে। এছাড়া খেলাফত মজলিশ কয়েকটি দল একত্রিত করার চেষ্টা করছে। চরমনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও চেষ্টা করছে ছোট কয়েকটি দলকে একত্রিত করতে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি আব্দুল লতিফ নেজামী বলেন, ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে বৃহৎ ইসলামী জোট গঠনের ব্যাপারে। জোট থেকে ৩০০ আসনেই নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিকল্পনা রয়েছে। এর পাশাপাশি জোট গঠনে বড় দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনা হচ্ছে। এদিকে দর কষাকষিতে আওয়ামী লীগের শরিক দল তরিকত ফেডারেশনও পিছিয়ে নেই। তারা এখন থেকেই ২০টি আসনে নির্বাচন করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।
এ বিষয়ে তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব এম এ আউয়াল বলেন, আগামী নির্বাচনে ২০টি আসনে তারা নির্বাচন করবেন। সে অনুযায়ী এখন থেকেই দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।