দর্শনা কাস্টমস সার্কেলের গোডাউন অফিসার শামীম সরকার মালামাল আতœসাতের ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত

দর্শনা অফিস: দর্শনা কাস্টমস সার্কেলের গোডাউন অফিসার মানেই অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়া। গোডাউন অফিসারের সাথে আতাত রেখে চোরাকারবারীরা ফায়দা লুটে থাকে প্রচুর। এবার শামীম সরকার নামের এক গোডাউন অফিসারের বিরুদ্ধে কোটি টাকার মালামাল আত্মসাতের অভিযোগে এলাকায় ব্যাপক আলোচনা-সমলোচনার ঝড় তুলেছে। পক্ষে-বিপক্ষে শোনা যাচ্ছে নানা কথা। কাস্টমস সার্কেলের ২ গোডাউন অফিসারের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুড়ির ঘটনা এখন অফিসের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এ আলোচনা এখন সর্বস্তরে ছড়িয়েছে। বিদায়ী গোডাউন অফিসার ইন্সপেক্টর শামীম সরকারের বিরুদ্ধে কোটি টাকা মালামাল আত্মসাতের অভিযোগ তুলেছেন বর্তমান গোডাউন অফিসার ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর আলম। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে দুজনের অভিযোগপত্র চালাচালি রয়েছে অব্যাহত। ঘটনার সঠিক তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। অবশেষে অভিযুক্ত শামীম সরকারকে করা হয়েছে সাময়িক বরখাস্ত। শামীম সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, বিভিন্ন সময়ে সীমান্তরক্ষী বিজিবি কর্তৃক আটককৃত মালামাল জমা দেয়া হয়ে থাকে দর্শনা কাস্টমস সার্কেলে। জমাকৃত কাঁচামাল প্রকাশ্য নিলামে বিক্রি করা হলেও গোডাউনে জমা রাখা হয়ে থাকে অন্যান্য চোরাচালানী সামগ্রী। জমাকৃত মালামালের মধ্যে রূপা, দামি বেনারশি শাড়ি, ব্রোঞ্জের মূর্তি, ইমিটেশন গয়না, ডায়িং কারখানায় ব্যবহৃত কেমিক্যাল, যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট, সাইকেল, মোটর সাইকেল, পার্স ইত্যাদি। অভিযোগ উঠেছে, গত বছরের ২৬ অক্টোবর বিজিবি কতৃক আটককৃত ৪৫ কেজি রূপা দর্শনা কাস্টমস এ জমা দেয়া হয়। গোডাউন অফিসার শামীম সরকার ওই রূপা চিহ্নিত এক চোরাকারবারীর কাছে প্রতি ভরি এক হাজার টাকা মূল্যে সর্বমোট ৩৮ লক্ষ ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন এবং ব্যাংকে জমা দেয়ার সময় আসল রূপার পরিবর্তে নকল রূপা জমা দিয়েছেন। একইভাবে তিনি গত ২৩ সেপ্টেম্বর ১ হাজার পিস ভারতীয় বেনারসি শাড়ি চোরাকারবারীচক্রের সদস্যের কাছে পিস প্রতি ৪ হাজার টাকা মূল্যে ৪০ লাখ টাকায় বিক্রয় করেন। যে শাড়িগুলোর বাজার মূল্য ছিলো প্রতি পিস কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা। ওই শাড়ির পরিবর্তে বাজার থেকে ৪-৫ শ’ টাকা দরের শাড়ি কিনে মূল্যবান শাড়ির শূন্যস্থান পূরণ করে রাখারও রয়েছে অভিযোগ। গত ৩ ডিসেম্বর ঢাকার এক ব্যক্তির নিকট ৫ লাখ টাকা মূল্যে এক সেট ব্রোঞ্জের গনেশ মূর্তি বিক্রি করে কর্তৃপক্ষের নজর ফাঁকি দিতে সরকারি রেজিস্টারে মূর্তির স্থলে হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজার সামগ্রী লিপিবদ্ধ করেন শামীম সরকার। গোডাউনে রক্ষিত ৩৪ কেজি ইমিটেশন গয়নার মধ্যে ২০ কেজি ৬শ’ গ্রাম গয়না বিক্রি করে অফিসের রেজিস্টারে ঘষামাজা করে ৩৪ কেজিকে ১৩ কেজি ৪০০ গ্রাম লেখার অপচেষ্টা চালিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন সময়ে আটককৃত নানা ধরণের কেমিক্যাল ও যৌন উত্তেজক ট্যাবলেটও তিনি বিক্রি করেছেন। শামীম সরকার এ পর্যন্ত কোটি টাকারও বেশি টাকার মালামাল বিক্রি করেছেন বলে উঠেছে অভিযোগ। গত ৩০ ডিসেম্বর গোডাউন অফিসার শামীম সরকারের স্থলে নতুন গোডাউন অফিসার জাহাঙ্গীর আলম যোগদান করেন। নতুন অফিসারের যোগদানের পর থেকেই বের হতে থাকে থলের বিড়াল। হিসেব ঝুঝিয়ে দেয়া নিয়ে শুরু হয় কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি। একে অপরকে ঘায়েল করতে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বরাবর শুরু হয় অভিযোগ লেখালেখি। জাহাঙ্গীর আলম দায়িত্বভার গ্রহণের পাশাপাশি গোডাউনের মালামাল বুঝে নিতে গেলে বাঁধে বিপত্তি। এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে গালাগালি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। বুঝমতো মালামাল না পেয়ে জাহাঙ্গীর আলম উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। গোডাউনের মালামাল সম্পূর্ণভাবে বুঝে না পাওয়ায় উভয়ের মধ্যে পুনরায় উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের ঘটনাও ঘটে। এ ব্যাপারে গোডাউন অফিসার শামীম সরকারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি সবকিছু নতুন গোডাউন অফিসারকে বুঝিয়ে দিয়েছি। গত ২০ ফেব্রুয়ারি দর্শনা স্থল শুল্ক স্টেশনের উপ-কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগের পাশাপাশি হিসেব বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে বলেও জানান শামীম সরকার। এ ব্যাপারে কাস্টমসের উপ-কমিশনার শায়েখ আরেফিন জাহেদি বলেন, গত বৃহস্পতিবার যশোর কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার শওকত হোসেনের স্বাক্ষরিত আদেশবলে শামীম সরকারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনাটি তদন্তের জন্য গত সোমবার শায়েখ আরেফিন জাহেদিকে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। কমিটি গঠনের ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ রয়েছে শায়েখ আরেফিন জাহেদির ওপর। তদন্ত কমিটির প্রধান বলেছেন, এখনও তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়নি। তবে আজকালের মধ্যেই তদন্ত কার্যক্রম শুরু করা হবে।
অভিযোগ সূত্রে জানাগেছে, গত ১ জানুয়ারি চাকরির প্রথম কর্মস্থল দর্শনা কাস্টম শুল্ক স্টেশনে যোগদান করেন কাস্টমস ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর আলম। দর্শনা কাস্টমস শুল্ক স্টেশনের গোডাউন ইনর্চাজ হিসেবে তিনি দায়িত্ব পান। সরকারি বিধি অনুযায়ী গত ৬ জানুয়ারি তার পূর্ববর্তী গোডাউন ইনচার্জ ইন্সপেক্টর শামীম সরকারের নিকট থেকে দায়িত্ব বুঝে নেয়ার সময় মালামালের গড়মিল দেখে ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর আলম দায়িত্ব বুঝে নিতে আপত্তি জানান। এ নিয়েই শুরু হয় দুজনের লড়াই। জাহাঙ্গীর আলম জানান, যেখানে জি আর নম্বর ১১৩/১৭, ১৬-০৮-২০১৭ইং তারিখে মালামাল আটক প্রতিবেদনে ভারতীয় শাড়ি ১০ পিস, থ্রি পিস ৮৬ পিস, পাঞ্জাবি ৩০ পিস, ওড়না ২০ পিস, ইমিটেশন ৮ কেজি থাকলেও দায়িত্ব হস্তান্তরের তালিকায় পণ্য হিসেবে ভারতীয় শাড়ী রয়েছে মাত্র ১০ পিস। জি আর ৫৩১/১৭, ১৬.০৮.১৭ তারিখে মটর সাইকেলের ব্রেক সু (বড়) ১শ’ পিস, মটর সাইকেলের ব্রেক সু (ছোট) ৪শ’ পিস, মটর সাইকেলের ক্যাস প্লেট (বড়) ১৫ পিস, মটর সাইকেলের ক্যাস প্লেট (ছোট) ১৫ পিস, পালসার মটর সাইকেলের হ্যান্ডেল ১০ পিস, হিরো হোন্ডা মটর সাইকেলের হ্যান্ডেল ১০ পিস রয়েছে। সেখানে দায়িত্ব হস্তাস্তর তালিতায় লেখা আছে শূণ্য। এ রকম আরও বাকি ১০টি জিআর প্রতিবেদনে উন্নতমানের মালামাল উল্লেখ্য থাকলেও তার পরিবর্তে নিম্নমানের পণ্য দেখানো হয়েছে। জিআর নাম্বার ৪৪৩/১৭ ভারতীয় ইমিটেশন ৩৪ কেজি উল্লেখ থাকলেও বর্তমান রেজিস্টারে ১৩ কেজি ৪শ’ গ্রাম লেখা রয়েছে। এতে করে প্রায় কয়েক কোটি টাকার মালামাল রয়েছে ঘাটতি। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত মালামাল স্বর্ণ ও রূপার প্রকৃত পরিমাণ ও প্রকৃত স্বর্ণ ও রূপা কি-না তা নিয়ে ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর আলমের সন্দেহ থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত স্বর্ণ ও রূপার সিটে স্বাক্ষর করতে আপত্তি থাকা সত্ত্বেও জোরপূর্বক স্বাক্ষর করাতে বাধ্য করানোর অভিযোগ উঠেছে শামীম সরকারের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রক্ষিত স্বর্ণ ও রূপার প্রকৃত পরিমাণ ও প্রকৃত স্বর্ণ এবং রূপা কি-না তা পরীক্ষার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন নবাগত কাস্টমস রাজস্ব কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর আলম।