তোকে মেরে ফেললে লস, ছেড়ে দিলে টাকা পাবো

স্টাফ রিপোর্টার: ‘তোকে মেরে ফেললেও লস, ছেড়ে দিলেও লস। তোকে ছেড়ে দিলে মাসে মাসে টাকা পাবো। তার চেয়ে তোকে ছেড়ে দেয়াই ভালো।’ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিককে ছেড়ে দেয়ার আগে অপহরণ চক্রের বড়ভাই (দলনেতা) একথাগুলো বলছিলেন। গতকাল শুক্রবার বিকেলে ধানমণ্ডির সেন্ট্রাল রোডের ৫৭/২ বাসায় অপহরণের বর্ণনা দিতে গিয়ে আবু বকর সিদ্দিক সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, অপহরণচক্রের লোকজন একজনকে বড়ভাই সম্বোধন করে কথা বলছিলো। তাদের ভাই পরিচয়ে একজন আসে। সেই বড়ভাই গত বুধবার রাত ১০টার দিকে প্রথম আমার সাথে কথা বলে। সে জানতে চায়, ‘আমি কোথায় চাকরি করি, কতো টাকা বেতন পাই। আমি তার সাথে কথা বলে জানতে চাই কোনো টাকা পয়সা চান কি-না। তাহলে আমি আমার পরিবারের সাথে কথা বলি। এ সময় সে আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) সকালে কথা বলবে বলে চলে যায়। সে চলে যাওয়ার পর যে দুজন আমাকে বাসায় পাহারা দিতো তারা আমার কাছে জানতে চায়, তুই এমন কে যে তোকে নিয়ে মিডিয়া এতো মাতামাতি করছে? কিন্তু আমি তো জানতাম না আমাকে নিয়ে রিজওয়ানা (স্ত্রী) এতো কিছু করছে। তিনি আরো বলেন, পরদিন (বৃহস্পতিবার) সকালে আমাকে নাস্তা দেয়া হয়। দুপুরে ভাত দেয়া হয়। রাতে খাবার দেয়, তা খাই।

আবু বকর বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১০ মিনিটের দিকে ওদের বড়ভাই আবার আসে। এসে আমাকে বলে, তোকে তো মেরে ফেললেও লস, ছেড়ে দিলেও লস। তোকে মেরে ফেললে টাকা পাব না, ছেড়ে দিলে টাকা পাব। এরপর ১০টা ১৫ মিনিটের দিকে আমাকে আবার চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে দেয়। ১ ঘণ্টা গাড়ি চলার পর আমাকে মিরপুরের আনসার ক্যাম্পের কাছে চোঁখবাধা অবস্থায় নামিয়ে দেয়। তারা আমাকে তিনশত টাকা দিয়ে বলে, এটা দিয়ে সিএনজি ভাড়া করে বাসায় যা। এরপর আমি রিকশা নিয়ে কাজীপাড়া আসি। সেখান থেকে একটি সিএনজিতে করে ধানমণ্ডির বাসার দিকে আসি। এ সময় ধানমন্ডি ক্লাবের সামনে টহল পুলিশ সিএনজি থামাতে বলে। সেখানে পুলিশকে আমি আমার পরিচয় দিই। এরপর ধানমণ্ডি থানায় নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। এর আগে আবু বকর সিদ্দিক অপহরণের বর্ণনা দিয়ে বলেন, গত বুধবার বিকেল ২টা ২৫ মিনিটের দিকে নারায়ণগঞ্জের অফিস থেকে ঢাকার বাসায় আসার জন্য রওয়ানা দিই। এ সময় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের লিংক রোডে পৌঁছুলে পিছন থেকে আমার গাড়িটিকে একটি গাড়ি ধাক্কা দেয়। তখন আমি গাড়ি থেকে নেমে আসি। দেখতে গেলাম গাড়ির কি অবস্থা। এ সময় ওই গাড়ি থেকে পাঁচ থেকে ছয়জন লোক নেমে আসে। আমাকে তাদের গাড়িতে তুলে নেয়। গাড়িতে তুলে আমার হাত, পা বেঁধে ফেলে এবং মুখে একটা মাস্ক পড়ানো হয়। তারা ধাক্কিয়ে আমাকে গাড়িতে শুইয়ে দেয়। দেড়ঘণ্টা গাড়ি চলার পর তারা আরেকটি গাড়িতে তোলে আমাকে। এ সময় আমার চোখ বাঁধাই ছিলো। তিন ঘণ্টা গাড়ি চলার পর একটি বাড়িতে নিয়ে যায় আমাকে। বাড়িতে নেয়ার পর সর্বক্ষণই আমার পাহারায় দুইজন লোক থাকত। অপহরণকারীদের বর্ণনা দিয়ে আবু বকর বলেন, তাদের প্রত্যেকের উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি হবে এবং খুব স্বাস্থ্যবান। তাদের মধ্যে একজনের পরনে খবু ভালো পোশাক ছিলো অর্থাৎ ফরমাল ড্রেস।

তিনি আরো বলেন, আমার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি ওরা। ওরা আমাকে তেমন কোনো রকম মারধর করেনি, টর্চারও করেনি। বাথরুমে যেতে চাইলে, বাথরুমে যেতে দিত। এ সময় চোখ খোলা হলেও বাথরুম থেকে বের হতে হত পেছন হয়ে। সামনে হয়ে বের হওয়া যেত না। আবু বকর বলেন, তারা আমার পাশে বসে টাকা-পয়সার বিষয়ে আলোচনা করলেও, আমাকে কিছু এ বিষয়ে বলেনি। আমি টাকা পয়সার কথা বললেও তাতে তারা তেমন আগ্রহ দেখায়নি। সংবাদ সম্মেলনে রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আগের অপহরণ ঘটনাগুলোর বিচার হলে এ ঘটনা ঘটত না। আমি চাইব এটিই হোক শেষ ঘটনা। তার স্বামীর অপহরণ ঘটনা পরিকল্পিত কি অপরিকল্পিত সেটা তিনি জানেন না উল্লেখ করে রিজওয়ানা বলেন, কেন তাকে ধরে নেয়া হলো সে বিষয়ে তিনি (সিদ্দিক) স্পষ্টভাবে কোনো ধারণা করতে পারেননি। তবে এ বি সিদ্দিককে যেখানে আটকে রাখা হয়েছিলো, সেখানকার লোকজনের কথাবার্তায় মনে হয়েছে, সেখানে এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটেছে বা ঘটে। শুধু তার (সিদ্দিক) ফিরে আসাতে দেশবাসী আশ্বস্ত হতে পারছে না। নাগরিক নিরাপত্তার স্বার্থেই এ ঘটনার রহস্য উদঘাটন হওয়া উচিত। বেলার নির্বাহী পরিচালক বলেন, অপহৃত হওয়ার শুরু থেকে ছাড়া পাওয়া পর্যন্ত বিস্তারিত আদালতে জবানবন্দিতে জানিয়েছেন তার স্বামী। তাকে আটক রাখার জায়গারও একটা আনুমানিক বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পাঁচ সদস্যের যে কমিটি হয়েছে, তারা এবি সিদ্দিকের জবানবন্দির ওপর নির্ভর করে এগোতে পারে। রিজওয়ানা বলেন, তার কর্মকাণ্ডের কারণে কোনো মহল ক্ষুব্ধ হয়ে থাকতে পারে। এমন সম্ভাব্যদের পরিচয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানো হয়েছে। তাদের সবাই প্রভাবশালী। গণমাধ্যমে তাদের নাম উল্লেখ করলে তারা প্রভাব খাঁটিয়ে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করতে পারে। এজন্য ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চান না। সম্প্রতি ধানমণ্ডিতে মাঠ দখলের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছে, তা নিয়ে শেখ জামালের সভাপতি মনজুর কাদেরসহ অন্যদের থেকে কোনো চাপ রিজওয়ানার পরিবারের প্রতি ছিলো কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে রিজওয়ানা বলেন, গণমাধ্যমে শালীনতার মাত্রা অতিক্রম করে কথা বলা অগ্রহণযোগ্য একটি কাজ। যেমন একজনকে গালি দেয়া কি ঔদ্ধত্যপূর্ণ কাজ না? সেটা আমাদের বাস্তবতায় প্রেসার হতেও পারে। ওই মুহূর্তে আমি কোনো প্রেসার ফিল করিনি। কারণ আমি ভেবেছি তার স্বার্থে আমার বক্তব্য আঘাত লেগেছে। কিন্তু যখন অপহরণ হয়ে যায়, তখন এ সমস্ত ঘটনাগুলোই কিন্তু আমার সামনে চলে আসে। কে কখন আমাকে অপমান করার চেষ্টা করেছে। কে কখন হেয় করার চেষ্টা করেছে। অনাবশ্যক ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে আমাকে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেছে। তখন এসব বিষয় ফ্যাক্টর হয়ে যায়। প্রেসার হয়তো বা না। আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, এ অপহরণের ঘটনা আমাকে আমার কাজ থেকে দূরে রাখার কৌশল হতে পারে। হয়তো বা এমনও হতে পারে এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে আগামী এক মাস কোনো কাজই করতে পারব না। এজন্য যে আমি ভয় পেয়ে বেলার কার্যক্রম গুটিয়ে নেব, এটা হতেই পারে না। এর আগে দেশে যেসব গুম-অপহরণের ঘটনা ঘটেছে, এ ৩৫ ঘণ্টায় তাদের স্বজনদের কষ্ট বোঝার চেষ্টা করেছি। আগের ঘটনাগুলোর বিচার হলে এ ঘটনা (এবি সিদ্দিকের) ঘটত না। আমি চাইব এটিই হোক শেষ ঘটনা যোগ করেন তিনি। এ বি সিদ্দিক অপহরণের পর তাকে উদ্ধারে রাষ্ট্রীয় সমর্থন পেয়েছেন উল্লেখ করে রিজওয়ানা বলেন, এ ঘটনার পর খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাই। বিএনপি চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ উদ্বেগ জানিয়েছেন। তাদের উদ্বেগের কারণেই আমার স্বামীকে দ্রুত ফিরে পেয়েছি। তিনি বলেন, আমার স্বামীকে অপহরণের পর থেকে গণমাধ্যম আমাদের সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়েছে। সাংবাদিকদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। গণমাধ্যম ও আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া তাকে ফেরত পাওয়া সম্ভব হতো না। রাজনীতিবিদরা সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে বিষয়টিকে মানবিকভাবে দেখেছেন। এজন্য তাদেরকেও ধন্যবাদ। একই সাথে তিনি দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, আমি দেশবাসীর কাছে সাংঘাতিকভাবে ঋণী।