ঝিনাইদহের ফুলহরি গ্রামে থামছে না কান্না : দুর্বিষহ স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াবে সারাজীবন

 

শাহনেওয়াজ খান সুমন: অন্য দশজনের মতোই সব আয়োজন ছিলো তাপস কুমার বিশ্বাসের বিয়েতে। গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবাই ব্যস্ত ছিলেন বিয়ের আনন্দ এবং খুঁনসুটিতে। সব রীতি মেনেই সম্পন্ন হয়েছিলো বরযাত্রা ও বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে শেষ হয়ে গেছে সব আনন্দ। বরযাত্রা হয়েছে অনেকের শবযাত্রা। এখন শোকে স্তব্ধ ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরি গ্রাম। রেলক্রসিঙে ট্রেনের ধাক্কায় বর যাত্রীবাহী বাসের ১১ জনকে হারিয়ে যেন কান্নাই থামছে না স্বজনদের। একদিন আগেও বিয়ে বাড়িতে যাদের নিয়ে আনন্দ করেছিলেন তাদের মধ্যেই অনেক প্রিয় মুখ আজ শুধুই স্মৃতি। প্রিয়জনের সাথে কাটানো সুখের গল্প বলতে বলতে আহাজারি করছেন অনেকে।

গতকাল শনিবার বিকেলে ফুলহরি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, থমথমে গোটা গ্রাম। কর্মব্যস্ততা নেই কারও মাঝে। শোকে সবাই যেন পাথর হয়ে গেছেন। নববধূ জ্যোৎস্না বিশ্বাসের চোখে খুশির বদলে ভর করেছে রাজ্যের হতাশা। পিতার বাড়ি ছেড়ে নববধূ জ্যোৎস্না বিশ্বাস শ্বশুরবাড়িতে পা রেখে কান্না থামাতে পারছেন না। বউভাতের অনুষ্ঠানের বদলে গ্রামের সবাইকে যোগ দিতে হয়ে শেষ কৃত্যানুষ্ঠানে।

কালীগঞ্জ উপজেলার সাকো মথনপুর গ্রামের সুবাস কুমারের মেয়ে জ্যোৎস্না বিশ্বাসের সাথে বৃহস্পতিবার রাতে বিয়ে হয় শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরি গ্রামের সাধন কুমার বিশ্বাসের ছেলে তাপস কুমার বিশ্বাসের। গাঁয়ের ছেলের বিয়ে, তাই বাস বোঝাই করে বরযাত্রী হয়ে ফুলহরি থেকে সাকো মথনপুরে গিয়েছিলেন আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা। গত কয়েকদিন ধরে উৎসবে মেতে ছিলো পুরো পরিবার। বিয়ের আসরেও সবকিছু ঠিকঠাক ছিলো। এরই মধ্যে শেষ রাতের পাখিটি বয়ে আনে দুঃসহ স্মৃতির বার্তা। বউ নিয়ে নিজেদের গ্রামে ফেরার পথে ভোর সাড়ে ৩টার দিকে বারোবাজার রেলক্রসিঙেই ঘটে দুর্ঘটনা।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা জ্যোৎস্না বলেন, আনন্দের বদলে বিয়ের দিনটি আমার জন্য বিষাদ হয়ে থাকলো। নিজেকে কোনোভাবেই বোঝাতে পারছি না। আমাদের বিয়ের জন্য এতোগুলো মানুষের প্রাণ গেলো। এ দুর্বিষহ স্মৃতি সারা জীবনই আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে। সামনাসামনি না হলেও আড়ালে জুটেছে ‘অপয়া’ অপবাদ। এই শোক-অপবাদের বোঝা বেশ ভারী মনে হচ্ছে তার।বর তাপস বিশ্বাসের জীবনটাই যেন থমকে গেছে হঠাত করে। বিয়েটাকে স্মরণীয় ও আনন্দময় করতে কাছের সকলকেই নিয়ে গিয়েছিলেন বরযাত্রায়। কিন্তু রাতের সেই আনন্দ বিলীন হয়ে গেছে সকালের সূর্য ওঠার আগে। জীবনের নতুন অধ্যায়ের শুরুটাই যে ঢাকা পড়লো শোকের অন্ধকারে।

প্রিয়জন হারানোর বেদনা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি। এই শোকে শুক্রবার সকালেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন তিনি। এখন একটু সুঃস্থ হলেও নিজেকে বারবার প্রশ্ন করছেন, এ আমি কী দেখলাম; আমার জীবনে কেন এমন হলো! কখনও দোষ দিচ্ছেন ভাগ্যকে, আবার কখনও ক্ষোভ ঝাড়ছেন রেলবিভাগের ওপর।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এই সহকারী শিক্ষক কান্না ভেজা কণ্ঠে আক্ষেপ করে বললেন, স্টেশনমাস্টার আর গেটম্যানের গাফিলতিতেই এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা। আবার কখনও বলছেন, আমাদের মাইক্রোবাসটি সামনেই ছিলো, কিন্তু নিরাপত্তার কারণে ঘটনার কিছু আগেই বাসটিকে সামনে নেয়া হয়। তাছাড়া পথে কিছু দেরি হয়েছে। এ সময় নষ্ট না হলে বোধহয় দুর্ঘটনার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যেতো।ওই মাইক্রোবাসে থাকা বরের ছোট বোন সংবাদকর্মী মুক্তি রানী বিশ্বাস বলেন, রেলগেট খোলা পেয়ে চালক কোনো কিছু না ভেবেই গাড়ি লাইনে উঠিয়ে দেন। এরপরই প্রচণ্ড শব্দে বাসটিকে ধাক্কা দেয় ঘাতক ট্রেনটি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্রেনের ইঞ্জিন বাসটিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। এ সময় প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে অনেকেই বাসের জানালা দিয়ে ছিটকে পড়েন। এই বলতে বলতেই তার কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে, কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

কথা হলো এই গ্রামের বাসিন্দা অরিত্র কুণ্ডুর সাথে। তিনি বললেন, গ্রামের প্রতিটি পরিবারেরই কেউ না কেউ এ দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সারাজীবন এ শোক তাড়িয়ে বেড়াবে আমাদের।ফুলহরি ইউনিয়নের সংরক্ষিত ইউপি সদস্য অনিতা বিশ্বাস বলেন, স্বজনহারাদের কান্নায় ভারী হয়েছ গ্রামের আকাশ-বাতাস। নিহতের স্বজনদের প্রতি সমবেদনা জানাতে শ’ শ’ মানুষ সেখানে ভিড় করছেন। কিন্তু তাদের সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ। অসহায় ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সহায়তার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।