ছাপার পরও পাঠ্যবই সংশোধন : দায় নিচ্ছেন না কেউ

 

স্টাফ রিপোর্টার: সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির দুটি পাঠ্যবই ছাপা হওয়ার পর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) নজরে আসে, হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী দুটি লেখা বাদ পড়েনি। তত দিনে প্রায় ১৫ লাখ বই ছাপা হয়ে গেছে। এরপর সেগুলো গুদামে রেখে ওই লেখা দুটি বাদ দিয়ে নতুন করে বই ছাপানো হয়।

এনসিটিবি সূত্র জানায়, দুই শ্রেণিতে মোট বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ৪ কোটি টাকা মূল্যের ১৫ লাখ বই ছাপা হয়ে গেছে। বাকি বই ছাপা শুরু হয়েছিল বা বাঁধাইয়ে ছিল। মুদ্রাকরদের হিসাবে, ছাপা বা সাদা কাগজ কোনো কাজে আসবে না। শুধু অব্যবহৃত কভার কাজে লেগেছে। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের লিখিত প্রস্তাবে মোট ২৯টি বিষয় সংযোজন ও বিয়োজনের কথা বলা হয়েছিল। এর মধ্যে এ দুটি লেখারও উল্লেখ ছিলো। ২৭টি লেখা গ্রহণ ও বর্জন করা হলেও দেখা যায়, দাবি অনুযায়ী ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত থাকা অষ্টম শ্রেণির রামায়ণ-কাহিনি (লেখক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী) এবং সপ্তম শ্রেণির লালু (শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) গল্প বাদ দেওয়া হয়নি। গল্প দুটিসহ বই ছাপা হওয়ায় বিপাকে পড়ে এনসিটিবি। এরপর ছাপা বই বাতিল করা হয় এবং সংশোধনের পর নতুন করে ছাপা হয়। এই পরিবর্তনে হেফাজতসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল সন্তোষ প্রকাশ করেছে।

কার নির্দেশে, কীভাবে এই পরিবর্তন হলো, তা কেউ স্বীকার করছে না। এ নিয়ে এনসিটিবিতে লিখিত কোনো সিদ্ধান্ত বা নির্দেশ নেই। যোগাযোগ করা হলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, প্রকাশনার কাজে অনেক সময় ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়। এ জন্য কোনো কোনো সময় কিছু পরিবর্তন আনতে হতেও পারে। তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নতুন বই ছাপা হয়। এবারও সেসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে। তবে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির একাধিক সূত্র বলছে, পাঠ্যবই ছাপার দায়িত্ব এনসিটিবির হলেও বড় ধরনের এই পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। ওপর থেকে আসা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে তারা। এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ‘আনন্দপাঠ’ দুবার ছাপা হয়েছে। সপ্তম শ্রেণিতে বইটি একবার ছাপা হয়েছে ‘লালু’ গল্প দিয়ে, আরেকবার ছাপা হয়েছে ‘লালু’ গল্প ছাড়াই। প্রথমে ছাপা বইয়ের পৃষ্ঠা ৬৬, পরে ছাপা বইয়ের পৃষ্ঠা ৬০। প্রথম বইয়ের সূচিপত্রে লেখা ছিল ১০টি, পরে ছাপা বইটিতে লেখা ৯টি।

অষ্টম শ্রেণির ‘আনন্দপাঠ’ বইটি একবার ছাপা হয়েছে ‘রামায়ণ-কাহিনি (আদিকাণ্ড)’ দিয়ে, আরেকবার ছাপা হয়েছে ওটা ছাড়াই। প্রথম ছাপায় লেখা ছিল আটটি, দ্বিতীয়বার সাতটি। প্রথমবার পৃষ্ঠা ছিল ৭২, দ্বিতীয়বার ৬৩।গত বছরের ৮ এপ্রিল হেফাজত লিখিতভাবে জানায়, ‘সপ্তম শ্রেণিতে “লালু” নামক গল্পে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে পাঁঠা বলির নিয়মকানুন। পড়ানো হচ্ছে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ “রামায়ণ”-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। হেফাজতের ২১ জন কেন্দ্রীয় নেতার যৌথ ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বর্তমানে স্কুল পাঠ্যপুস্তকে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের নাস্তিক্যবাদ ও হিন্দুতত্ত্বের পাঠ দেওয়া হয়ে থাকে। তাদের পড়ানো হয় গরুকে মায়ের সম্মান দিয়ে ভক্তি করার, পাঁঠা বলির নিয়মকানুন, হিন্দু বীরদের কাহিনি, দেব-দেবীর নামে প্রার্থনা এবং হিন্দুদের তীর্থস্থান ভ্রমণ করার বিষয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে ১৭টি লেখা বাদ পড়েছে। ওই ১৭টি লেখা পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করার দাবি জানায় হেফাজতে ইসলাম। অন্যদিকে নতুন করে যুক্ত ১২টি লেখা বাদ দিতে বলে তারা। এই ১২টি লেখা ২০১৩ সালে পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করা হয়েছিলো

নসিটিবির সূত্র জানায়, এই ২৯টি লেখার বিষয়ে হেফাজতের বক্তব্য মেনে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুটি লেখা ‘লালু’ ও ‘রামায়ণ-কাহিনি’ ভুলক্রমে বাদ দেওয়া হয়নি। এই ভুল যখন ধরা পড়ে, তখন বইয়ের একটি বড় অংশ ছাপা হয়ে যায়। বাকিগুলো ছাপা বা বাঁধাই পর্যায়ে ছিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মুদ্রাকর বলেন, মুদ্রাকরদের এই ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য এনসিটিবি। এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, বইয়ের সংখ্যা ও ক্ষতিপূরণের টাকা এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট করা হয়নি। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, হেফাজতকে রাজনৈতিকভাবে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এটা ভোটের রাজনীতির অংশ। তবে এই আপসকামিতা কারও জন্য সুখকর হবে না। তিনি বলেন, পাকিস্তান আমলে মোনায়েম খানের সময়ে এমনই অবস্থা হয়েছিলো। তখন পাঠ্যবইয়ে জসীমউদ্‌দীনের ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতাটিকে ‘দাওয়াত’ এবং নজরুল ইসলামের কবিতায় ‘মহাশ্মশান’ শব্দটিকে ‘গোরস্থান’ করা হয়েছিল। এরপর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়। সেই দেশে আজ যা চলছে, তা অকল্পনীয়, বিস্ময়কর।

পাঠ্যবই ছাপার মূল দায়িত্ব এনসিটিবির, যেটি কাগজে-কলমে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানের কাজকর্মে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নেই। এত বড় পরিবর্তন যে প্রক্রিয়ায় হওয়ার কথা, সেটি মানা হয়নি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান ও দুজন সদস্য সদুত্তর দিতে পারেননি।