ছাত্রলীগের সংঘর্ষে শাবিপ্রবি রণক্ষেত্র : শিক্ষার্থী নিহত

স্টাফ রিপোর্টার: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় দুপক্ষই পরস্পরের দিকে গুলি ও ককটেল ছোড়ে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, পুলিশসহ আরও অন্তত ৫০ জন আহত হন। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ এক ছাত্রলীগ কর্মীর অবস্থা আশঙ্কাজনক।

নিহত শিক্ষার্থীর নাম সুমন চন্দ্র দাস। তিনি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার শ্যামার চড় গ্রামের কৃষক হরিদাসের একমাত্র ছেলে। চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়তেন। ইউনিভার্সিটির ছাত্রাবাসেই থাকতেন তিনি।

এ ঘটনার পর জরুরি বৈঠক ডেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে সিন্ডিকেট। বৈঠকের পর গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলেই ছাত্রদের এবং শুক্রবার সকাল ৯টার মধ্যে ছাত্রীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কার্যক্রম এ ঘোষণার আওতার বাইরে থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও ২৫ নভেম্বর ভর্তি পরীক্ষা পূর্বনির্ধারিত সময়েই অনুষ্ঠিত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থ ও সহ-সভাপতি অঞ্জন রায় গ্রুপের মধ্যে এ বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। দু পক্ষের মধ্যে অন্তত ৪০ রাউন্ড গুলি বিনিময় হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনতে পুলিশ ৯৩ রাউন্ড রাবার বুলেট ও ১৮ রাউন্ড টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে।

ক্যাম্পাস ও হলের পাশে বহিরাগত ক্যাডার নিয়ে ছাত্রলীগের উভয়গ্রুপের নেতাকর্মীরা অবস্থান করায় আবারও বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সংঘর্ষ এড়াতে ক্যাম্পাসে দু প্লাটুন অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

জানা গেছে, গত বছর ৮ মে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাত সদস্য বিশিষ্ট কমিটি হওয়ার পর থেকে সহসভাপতি অঞ্জন রায় ছাড়া কমিটির অন্য সদস্যরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারেননি। কমিটির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে হল ও ক্যাম্পাসে আধিপত্য ধরে রাখে পদবঞ্চিতরা। পদবঞ্চিতদের নেতৃত্ব দেন অঞ্জন রায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সদস্য উত্তম কুমার দাস। গতকাল বৃহস্পতিবার ক্যাম্পাস দখলে নিতে সভাপতি পার্থ ও তার লোকজন সশস্ত্র অবস্থায় সিএনজিতে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে গ্রন্থাগার ভবন এবং একাডেমিক ভবন ডিতে ভাঙচুর চালান। এদের মধ্যে সহসভাপতি আবু সাঈদ আকন্দ, যুগ্ম সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম সবুজ এবং বহিরাগত অনেকে ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান ও মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক পীযুষ কান্তি দের অনুসারী বহিরাগত ক্যাডাররা তাণ্ডবে অংশ নেন। তারা ক্যাম্পাসে সশস্ত্র অবস্থান নিয়ে কমিটিকে স্বাগত জানিয়ে পদবঞ্চিত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে স্লোাগান দিতে থাকেন। এ সময় তারা পদবঞ্চিতদের নেতৃত্বদানকারী অঞ্জনের কর্মী মঞ্জুকে পিটিয়ে আহত করেন। তারা শাহপরাণ হলের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান এবং দেশীয় অস্ত্র দা, রামদা, হকিস্টিক উঁচিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে হলে অবস্থানরতদের বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। পরে হল গেটে তালা ঝুলিয়ে বিভিন্ন ব্যানার ছিড়ে আগুন লাগিয়ে দেন।

খবর পেয়ে দ্বিতীয় ছাত্র হল ও ক্যাম্পাসে অবস্থান নেন পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা। পদবঞ্চিতদের নেতা অঞ্জন রায়, শফিকুল ইসলাম শফিক, সেলিম আহমদ, আবদুল হালিম, মোস্তাকিম আহমদ মোস্তাক, দ্বৈপায়ন দত্ত রুমনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ ও মহানগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক বিধান সাহার অনুসারী ক্যাডাররা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে পাল্টা হামলা চালান। তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের সামনে এলে সংঘর্ষ শুরু হয়। উভয় গ্রুপের নেতাকর্মীরা একে অপরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকেন। এতে গুলিবিদ্ধ হন পদবঞ্চিতদের অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মী সুমনসহ পাঁচজন। গুরুতর আহত অবস্থায় সুমনকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আহতদের মধ্যে খলিল নামে এক ছাত্রলীগ কর্মীর অবস্থা আশংকাজনক।

পদবঞ্চিতদের নেতা অঞ্জন রায়কে বিশ্ববিদ্যালয় সেন্টারের সামনে রামদা দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অধ্যাপক ড. হিমাদ্রি শেখর রায় এগিয়ে এলে পুলিশের গুলিতে তিনি আহত হন। পরে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে নেয়া হয়।

সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এক পর্যায়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করে পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে আবাসিক হল শাহপরাণে ফিরে গিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন কমিটির সদস্যরা। বিকেল ৩টার দিকে আবার সশস্ত্র অবস্থায় দ্বিতীয় ছাত্রহলের সামনে জড়ো হন পদবঞ্চিতরা। তারা ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে দু হলের মধ্যবর্তী ফটকের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে কমিটির সদস্যদের সাথে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় পদবঞ্চিতদের গুলিতে পুলিশ সদস্য ইবরাহিম আহত হন। পরে পুলিশ সদস্যরা সাঁজোয়া যান নিয়ে দ্বিতীয় ছাত্রহলের দিকে গেলে উভয়গ্রুপের নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

দিনব্যাপি সংঘর্ষে অঞ্জন, খলিল, সেলিম, মোস্তাক, কামরুল, জিয়া, জাবেদ, নজরুল, আনোয়ার, জুয়েল, জহির, আরিফুল ইসলাম কেনেডি, মঞ্জু, সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম মিঠু ও উজ্জ্বলসহ কমপক্ষে অর্ধশত আহত হন। সুমন নিহত হওয়ার ঘটনায় বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে রাখেন পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম সবুজ দাবি করেন, কমিটির সদস্যরা শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে হলে যেতে চাইলে অঞ্জন-উত্তম গ্রুপের নেতারা বহিরাগতদের নিয়ে তাদের ওপর অতর্কিত হামলা করেন। হামলায় তাদের ৩০ নেতাকর্মী আহত হন। তিনি বলেন, অঞ্জন-উত্তমের কর্মীরা বহিরাগতদের নিয়ে হলে অবস্থান করছেন। আমরা হলের বৈধ ছাত্র হলেও এক বছর ধরে হলে উঠতে বাধা দিচ্ছেন তারা। অপর গ্রুপের নেতা মোস্তাকিম আহমেদ মোস্তাক বলেন, পার্থ-সাইদ-সবুজ বহিরাগতদের নিয়ে হলে হামলা করেন। তাদের হামলায় ছাত্রলীগের একজন নিহত এবং অনেকে আহত হয়েছেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেফতার করতে হবে। হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত ক্যাম্পাস যখনই খুলবে, তখন থেকে অনির্দিষ্টকালের ছাত্র ধর্মঘট চলবে।

সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) রহমত উল্লাহ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপই সক্রিয়। একটি ক্যাম্পাসের ভেতরে, অন্যটি বাইরে। তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলো। জালালাবাদ থানার ওসি আখতার হোসেন জানান, বর্তমানে ক্যাম্পাস শান্ত রয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় কোনো মামলা বা কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।

তদন্ত কমিটি: সংঘর্ষের ঘটনায় সাবেক কোষাধ্যক্ষ ও গণিত বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইলিয়াস উদ্দিন বিশ্বাসকে আহ্বায়ক করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সিন্ডিকেট সভা থেকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে সিন্ডিকেট সদস্য সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ ফারুক উদ্দিন জানান। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনুস ও ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. নজরুল ইসলাম।