চুয়াডাঙ্গায় আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব : দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে একে একে বিলুপ্ত ৩ কমিটি

১৪ বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি পায়নি যুবলীগ : কমিটি নেই কলেজ ও জেলা ছাত্রলীগের
স্টাফ রিপোর্টার: দীর্ঘ ১৪ বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটির মুখ দেখেনি চুয়াডাঙ্গা জেলা যুবলীগ। এতদিন আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চালানো হলেও এক বছরেরও বেশি সময় ধরে যুবলীগ চলছে কমিটি ছাড়াই। একই দশা চুয়াডাঙ্গা জেলা ছাত্রলীগ ও চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের। কোনো কমিটি ছাড়াই চলছেন নেতাকর্মীরা। একেকটি ঘটনার প্রেক্ষিতে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ তুলে যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। তবে এখানে দলে আভ্যন্তরিণ দ্বন্দ থাকায় কেউই সঠিকভাবে বলতে পারছেন না কবে নাগাদ পুনরায় কমিটি গঠন করা হবে। এবং তা কোন দিকে গড়াবে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালের ১৪ নভেম্বর গঠিত জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ছিলেন আরেফিন আলম রঞ্জু। নানা কারণে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে ওই আহ্বায়ক কমিটিই দায়িত্ব পালন করে। পরবর্তীতে ২০১৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় যুবলীগ ওই আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করে পুনরায় ২১ সদস্যের নতুন আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন করে। কমিটির আহ্বায়ক করা হয় ওবায়দুর রহমান চৌধুরী জিপুকে। এ কমিটি অনুমোদনের পর চুয়াডাঙ্গা উত্তাল হয়ে ওঠে। পক্ষে-বিপক্ষে শুরু হয় মিছিল মিটিং ও বিক্ষোভ-সমাবেশ। কমিটি অনুমোদনের দু’মাসের মাথায় ১৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় নঈম হাসান জোয়ার্দ্দারের সমর্থক বলে পরিচিত যুবলীগ কর্মী ডিঙ্গেদহের আজিজুল ইসলাম খুন হন। আহত হন আওয়ামী লীগ কর্মী বুদো ম-ল। পরদিন দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে চুয়াডাঙ্গা জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় যুবলীগ। সেই থেকে কমিটি বিহীন রয়েছে জেলা যুবলীগ। তবে দু পক্ষই নিজেদের মতো করে চেষ্টা তদবির চালিয়ে যাচ্ছে কমিটি নিজ নিজ পক্ষে আনার জন্য। দু পক্ষের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে এমনই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আবার অনেক নেতাকর্মী মনে করেন দুই গ্রুপের সমন্বয়ে হয়তো কোনো কমিটি আসতে পারে চুয়াডাঙ্গায়। যাতে পরিস্থিতি শান্ত থাকে। এ ব্যাপারে যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র ওবায়দুর রহমান চৌধুরী জিপু বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি,  পুনরায় আমার নেতৃত্বেই যুবলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ফিরে পাব। কারণ আমার পক্ষেই নেতাকর্মীরা বেশি আছেন। আমি যুবলীগের রাজনীতিকে আরও শক্ত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অপর পক্ষের নেতৃত্বে থাকা যুবলীগ নেতা নঈম হাসান জোয়ার্দ্দার বলেন, ‘কমিটি না থাকলে নানা সমস্যায় পড়তে হয়। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হই। তবে কমিটি না থাকলেও জেলা যুবলীগকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে দৃঢ় অবস্থানে রেখেছি। তাছাড়া চুয়াডাঙ্গার রাজনীতিতে আমার পক্ষেই সিংহভাগ যুবলীগের নেতাকর্মী ও যুবসমাজ রয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটি ইচ্ছে করলে চুয়াডাঙ্গায় এসে যাচাই বাছাই করুক। তারা চুয়াডাঙ্গায় আমার বিকল্প নেতৃত্ব খুঁজে পাবেন না। আমি বিশ্বাস করি মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতি বিবেচনায় কমিটির অনুমোদন দেয়া হলে আমার নেতৃত্বেরই বিজয় হবে।’
বছর কয়েক আগে জেলা ছাত্রলীগে বিভক্তি দেখা দেয়। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শরীফ হোসেন দুদু ও সাধারণ সম্পাদক মোহাইমেন হাসান জোয়ার্দ্দার অনিক দুটি গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন। এরই মধ্যে চলতি বছরের ১২ মার্চ চুয়াডাঙ্গার ফেরিঘাট রোড এলাকায় দিনদুপুরে ভুলু (২৪) নামের এক যুবককে কুপিয়ে খুন করা হয়। আকাশ (২২) নামে আরেক যুবক জখম হয়। জেলা ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে এ খুনের ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ ওঠে। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ওই দিনই জেলা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। দীর্ঘ ১০ মাস হয়ে গেলেও কমিটির ব্যাপারে তেমন কিছু শোনা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে বেকায়দায় আছেন নেতৃবৃন্দ। কমিটি না থাকলে তাদেরকে নানাবিধ সমস্যায় পড়তে হয়। যে কোনো ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সামাল দেয়া এবং দলতে সুসংগঠিত করতে হলে কমিটির বিকল্প নেই বলে জানালেন জেলা ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ। জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শরীফ হোসেন দুদু বলেন, ‘কমিটি না থাকলে অনেক সমস্যা হয়। দলকে এগিয়ে নিতে হলে সাংগঠনিক ভিত্তি ছাড়া সম্ভব নয়। তবু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি দলকে মজবুত অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আগামী জানুয়ারিতে জেলা ছাত্রলীগের কমিটি আসবে বলে মনে করছি।’
অন্যদিকে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাইমেন হাসান জোয়ার্দ্দার অনিক বলেন, ‘কমিটি ছাড়া নেতৃত্ব দেয়া জটিল ব্যাপার। জানুয়ারিতে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। দিনটি ঘটা করে উদযাপনের যতোটা ইচ্ছে আছে, ততোটা পারছি না। তবে কমিটি থাকলে হয়তো নেতাকর্মীদের মধ্যে স্বতঃর্স্ফূত ভাব থাকতো। নেতৃবৃন্দ নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকলে কর্মসূচিগুলো পালন যেমনি সহজ হয়, তেমনি তা প্রাণবন্ত হয়। তবে সব সমস্যা মোকাবেলা করে ছাত্রলীগকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। ছাত্রলীগকে আরও শক্ত অবস্থানে নিয়ে যেতে চাই। এ জন্য ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সহযোগিতায় প্রাণান্ত চেষ্টা রয়েছে আমার। আশা করছি জেলা পরিষদ নির্বাচনের পরেই হয়তো ছাত্রলীগের জেলা কমিটি হাতে পাবো।
অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ ছাত্রলীগকেও বিলুপ্ত করা হয়েছে। মাস দেড়েক আগে কেন্দ্রীয় কমিটি কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে। অভিযোগ রয়েছে, কমিটির সাধারণ সম্পাদক তানিম হাসান তারেক গত ১১ নভেম্বর রাতে কলেজের এক নারী কর্মচারীর বাসায় যান এবং জোরপূর্বক তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। পরদিন ওই নারী কর্মচারী ছাত্রলীগ নেতা তারেকের বিরুদ্ধে থানায় ধর্ষণ চেষ্টার মামলা করেন। একই দিন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ ছাত্রলীগ বিলুপ্ত ঘোষণা করে। সেই থেকে চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ ছাত্রলীগও চলছে কোনো কমিটি ছাড়াই। কমিটি না থাকলে দলীয় কর্মসূচি পালন করতে যেমনি বিড়ম্বনায় পড়তে হয়, তেমনি দলকে এগিয়ে নেয়ার স্পৃহা থাকে না নেতাকর্মীদের মধ্যে। এমনই মন্তব্য করলেন সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি আশিক ইকবাল স্বপন। তিনি বলেন কমিটি না থাকায় কলেজের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে খুব বেগ পেতে হয়। আমরা চাই কেন্দ্রীয় কমিটি পুনরায় কলেজ কিমিটির অনুমোদন দেবে। তাতে কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতি উজ্জীবিত হয়ে উঠবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, চুয়াডাঙ্গায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগে গ্রুপিং থাকার কারণে অনেক নেতা-কর্মী দোদুল্যমান অবস্থায় আছেন। কোন পক্ষ কমিটি পাবে আর কোন পক্ষ বঞ্চিত হবে তা নিয়ে তাদের মধ্যে এক রকম সন্দেহ-সংশয় লেগেই আছে। অনেকেই আছেন চুপচাপ অবস্থানে। তারা মনে করছেন যারাই কমিটিতে আসবেন তাদের পক্ষেই রাজনীতি করবেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেক নেতাকর্মী বলেন, আমরা গ্রুপিং বুঝি না, যারা কমিটির নেতৃত্ব পাবেন তাদের সাথেই রাজনীতি করবো।