এখন এক টাকাও দিতে হবে না : মালয়েশিয়ায় গিয়ে কাজ করে টাকা দিবা

আলমডাঙ্গায় বিনা পাসপোর্ট-ভিসায় পানিপথে মানবপাচারের অর্ধশতাধিক দালাল গাঢাকা

 

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: ‘এখন এক টাকাও দিতে হবে না। মালয়েশিয়া গিয়ে কাজ করে টাকা দিবা। তোমার পকেট থেকে এক টাকাও লাগবে না।’ ভেবে দেখো। মানুষ জমিজমা বিক্রি করে বছরের পর বছর ঘুরেও মালয়েশিয়া যেতে পারছে না। আর তুমি তো ফ্রি ফ্রি যাবা। ‘পানিপথে মানবপাচারকারী আদমদালালরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে অপেক্ষাকৃত সরলসোজা অভাবী যুবক ও অতিউৎসাহী উঠতি বয়সী কিশোরদের বিদেশ যেতে রাজি করাতে এমন কথার ফুলঝুরি ঝরাতেন। কথার এমন মোক্ষম টোপে কাজ না হলে তার জন্য ছিলো ভিন্ন টোপ। বিদেশ অবস্থান করছে এমন কারো গল্প ফুলিয়ে-ফাপিয়ে এমনভাবে বলতো যাতে শিকার মনে করতে বাধ্য হতো যে, বিদেশে গিয়ে টাকা কামানোর মতো সহজ কাজ আর নেই। সেখানে একবার যেতে পারলে আবার ঠেকায় কে? এক তুড়িতেই বড়লোক!

বিনা পাসপোর্ট-ভিসায় পানিপথে বিদেশে পাড়ি জমানো কয়েকজন অবস্থা বেগতিক দেখে কোনোভাবে পালিয়ে বাড়িতে ফিরেছে, এ গল্প তাদের নিকট থেকে শোনা। এমন কথার পাকে ফেলে আলমডাঙ্গা উপজেলার বেশ কয়েকশ উঠতি বয়সী কিশোর ও যুবকদের সর্বনাশ ঘটিয়েছে চিহ্নিত আদম দালালরা। মূলত আলমডাঙ্গার রেললাইনের উত্তর ভাগে আদমপাচারকারীদের ঘাঁটি।

প্রায় ৯ মাস আগে কক্সবাজার থেকে ছোট নৌকায় চড়ে থাইল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হয়ে পাচারকারীদের নির্যাতনের শিকার টোটন বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, চার ঘণ্টা ছোট নৌকায় চলার একপর্যায়ে সাগরের মাঝপথে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর সহায়তায় বড় একটি নৌকায় তোলা হয় তাকে। বড় নৌকায় তোলার পর শুরু হয় টোটনসহ অন্যদের ওপর নির্যাতন। সেখান থেকে ১০ দিন পর তাকে সঙ্খলা জঙ্গলে আনা হয়। মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী এ জঙ্গলে টোটন সাহাকে আনার পর তার মা কানন সাহাকে মালয়েশিয়ার সিম ব্যবহার করে ফোন দেন মানবপাচারকারীরা। ফোনে তারা টোটনের মাকে বলেন, ছেলে মালয়েশিয়ায় পৌঁছে গেছে, এবার টাকা পাঠান’। টোটনের মায়ের কাছে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা দাবি করে মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা। দরিদ্র টোটন সাহার মা কোনোমতে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা সংগ্রহ করে মানবপাচারকারী মাফিয়াদের হুন্ডি করে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু এতেও মন গলেনি পাচারকারীদের। টাকা পাওয়ার পর চলে অমানসিক নির্যাতন। তাকে নিয়মিত খেতে দেয়া হতো না। পুরো টাকা পাঠানো সম্ভব হয়নি বলে তাকে দীর্ঘ সাত মাস মানবপাচার চক্র জঙ্গলে ওদের ক্যাম্পে বন্দি করে রাখে। একপর্যায়ে মাফিয়াদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন টোটন। জঙ্গলে এখানে-ওখানে ঘুরে প্রায় দু মাস পার করেন তিনি। জঙ্গলের বিভিন্ন ধরনের পাতা-ফল খেয়ে বেঁচে ছিলেন তিনি। গত ১ মে স্থানীয় রাবার শ্রমিকরা তাকে উদ্ধার করে। এরপর ২ মে আরো ১৪ জন বাংলাদেশিকে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে তারা ইমিগ্রেশন ডিটেনশন সেন্টারে আছে। তারা স্থানীয়দের জানিয়েছেন, ‘রাষ্ট্রবিহীন’ রোহিঙ্গারা মানবপাচারকারীদের মুক্তিপণের টাকা সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়। আর যারা টাকা দিতে পারেন তাদের মালয়েশিয়ায় পাঠানো হতো। কিন্তু এভাবে কষ্ট সহ্য করতে হবে জানলে কখনো অবৈধ পথে বিদেশ যেতাম না। তারা কাউকে এভাবে বিদেশ পাড়ি না দিতে আহ্বান জানান।

আলমডাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা যায় বিভিন্ন গ্রাম থেকে বেশ কয়েকশ উঠতি বয়সী কিশোর-যুবককে পানিপথে মালয়েশিয়ায় নেয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে চরম সর্বনাশ ঘটানো হয়েছে। বিনা পাসপোর্ট ও ভিসায় তাদেরকে এ বিপদে ঢেলে দেয়া হয়েছে। মোটাঅঙ্কের টাকা বেতনের স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের বেশির ভাগকেই পরিবারের অগোচরে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর দাবি। আলমডাঙ্গার হাটবোয়ালিয়া, নগরবোয়ালিয়া, ভাংবাড়িয়া, ওসমানপুর, প্রাগপুর, লক্ষ্মীপুর, হারদী, পারদূর্গাপুর, বণ্ডবিল, রোয়াকুলি, জোড়গাছা, আসাননগর প্রভৃতি গ্রামে এ ভয়াবহ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। পানিপথেই এদের প্রায় ২৫ ভাগেরই করুণ মৃত্যু হয়েছে বলে অনেক ওয়াকিবহাল মহল দাবি করেছে। নগরবোয়ালিয়ার রাসেলসহ এদের অনেককেই বেদম পিটিয়ে সমুদ্রে ফেলে মারা হয়েছে। প্রায় অর্ধেকের সাথে পরিবারের স্বজনদের গত কয়েক মাসে একবারের জন্যও মোবাইলফোনে যোগাযোগ হয়নি। এদের কেউ ৬ মাস আবার কেউ ১ বছরের অধিক সময় ধরে নিখোঁজ বলে পরিবারের দাবি। বন্ডবিল, রোয়াকুলি, জোড়গাছা, কেদারনগর, শেখপাড়া, ওসমানপুর, প্রাগপুর, ভাংবাড়িয়া, হাটবোয়ালিয়া, নগরবোয়ালিয়া, পার্শ্ববর্তী গাংনীর হেমায়েতপুর, রুয়েরকান্দি, আমতৈলসহ প্রভৃতি গ্রামের শ শ লোককে বিনা পাসপোর্ট ও ভিসায় পানিপথে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এদের বেশিরভাগই অতি উৎসাহী উঠতি বয়সী কিশোর। গাংনী উপজেলার হেমায়েতপুর, রুয়েরকান্দি, আমতৈল, আলমডাঙ্গার হাটবোয়ালিয়া, নগরবোয়ালিয়া, ভাংবাড়িয়া, শেখপাড়াসহ বিভিন্ন গ্রামের শ শ লোক এভাবে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে হেমায়েতপুরের শুকুর আলীর ছেলে জাহিদের বিরুদ্ধে। একই গ্রামের আরেক প্রভাবশালি দালালের নাম কাশেম। হাটবোয়ালিয়া এলাকার কয়েকজন জানিয়েছেন, পানিপথে অবৈধভাবে অনেকের সাথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমিয়েছিলেন শেখপাড়ার জনৈক এক যুবক। থাইল্যান্ডে বেশ কয়েক মাস জেল খাটার পর তিনি ফিরে এসেছেন। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী তারা এক সাথে ৫শ ২৫ জন ছিলেন। পানিপথে যাওয়ার সময় সাগরেই মৃত্যু হয়েছে ৭৫ জনের। এছাড়া আলমডাঙ্গার নগরবোয়ালিয়ার ঠাণ্ডুর কিশোর ছেলে রাশেদ, ইয়াকুবের ছেলে শাহ জামাল, গাংনীর হেমায়েতপুরের নিহাজ উদ্দীনের ছেলে কালু, রুয়েরকান্দির আয়ুব কালার ছেলে বাবলুকে পানিপথেই সমুদ্রে ফেলে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাশেদসহ একাধিক কিশোর খাবারের জন্য কান্নাকাটি করায় তাদের তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ভুক্তভোগী অনেক পরিবার অভিযোগ করেছে, প্রথমে দালাল কোন টাকা লাগবে না, মালয়েশিয়ায় গিয়ে কাজ করে টাকা শোধ দিতে হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে আর সে কথা রাখেনি। নৌকায় তুলে সমুদ্রের মাঝে নিয়ে টাকার জন্য নির্যাতন করে মোবাইলফোনে টাকা চায় এ সব নরপশু দালাল। টাকা না দিলে হত্যা করে সাগরে ফেলে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। সন্তানের মৃত্যুর আশঙ্কায় উৎকণ্ঠিত হয়ে বসতবাড়ির জমি পর্যন্ত বিক্রি করে অনেকে দালালের টাকা পরিশোধ করেছে। তবে এখনও অবধি প্রিয় সন্তানের খবর অনেকে পায়নি। মারা গেছে নাকি বেঁচে আছে? পানিপথে মালয়েশিয়া গমনকারী বন্ডবিল গ্রামের ৬ ব্যক্তির কোনো সংবাদ না পেয়ে এমনিতেই তাদের পরিবার ছিল উৎকণ্ঠিত। বর্তমানে টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে গণকবর আবিষ্কার ও শ শ বাংলাদেশির লাশ উদ্ধারের সংবাদ দেখে তারা একেবারে ভেঙে পড়েছে। পরে থাইল্যান্ডের জঙ্গল থেকে উদ্ধার হওয়া প্রায় শতাধিক মৃতপ্রায় ব্যক্তির মধ্যে বন্ডবিলের একজন জীবিত আছে এ সংবাদ জানলেও ৬ জনে মধ্যে কোন ভাগ্যবান সে তা কেউ জানতে পারেনি। প্রায় সোয়া ১ মাস পূর্বে তারা কোনো প্রকার পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই বাড়ির কাউকে না বলে দালালের খপ্পরে পড়ে পানিপথে মালেশিয়া পাড়ি জমায়। বাড়ি থেকে যাওয়ার পর আজোবধি তাদের কোন সংবাদ পায়নি পরিবার পরিজন। প্রাগপুরের প্রায় ২০ জন ছেলেকে পানিপথে বিদেশ নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ২/৩ জনের কোনো সংবাদ কেউ দিতে পারেনি। অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা আর বেঁচে নেই। এছাড়া পার্শ্ববর্তী ওসমানপুরের প্রায় ৩০ জন যুবককে পানিপথে বিদেশ নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এদের মধ্য রইচ উদ্দীনের ছেলে নজু, ফটিকের ছেলে তোতা, ঘোষের ছেলে শরিফসহ অনেকেরই আর আজোবধি সন্ধ্যান মেলেনি।

    যেভাবে নিয়ে যাওয়া হতো: আলমডাঙ্গা এলাকায় প্রায় অর্ধশতাধিক মানবপাচারকারী দালাল সক্রিয় ছিলো বলে অনেকের দাবি। তৃণমূল পর্যায়ের একাধিক দালালের সাথে খোলামেলা কথা বলে জানাগেছে, শিকার প্রতি তাদেরকে কখনও বা ৫/৭ আবার কখনও বা ১০ হাজার করে টাকা দেয়া হতো। কেউ একবারের জন্য রাজি হলেই তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঢাকার গাবতলি, অথবা সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে গিয়ে অন্য দালালের হাতে তুলে দিতো। অনেক সময় আবার চট্টগ্রামে পৌঁছে দিতো। নিয়ে যাওয়ার যাতায়াত খরচ আলাদা দিতো। দালাল পরিবর্তন হওয়ার পর তাদেরকে নেয়া হতো চট্টগ্রামের উখিয়ায়। সেখান থেকে নৌকাতে করে থাইল্যান্ডের উদ্দেশে সাগর পাড়ি দেয়ার জন্য নেয়া হতো। বেশিরভাগ সময় তাৎক্ষণিকভাবে এ সুযোগ মিলতো না। সে জন্য অপেক্ষা করতে হতো সপ্তার পর সপ্তা। উখিয়াসহ আশপাশের এলাকায় ঘর ভাড়া করে পাচারের জন্য সংগৃহীত শিকারদের রাখা হতো। এ সময় অবস্থা বেগতিক দেখে অনেক চালাক যুবক পালিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

            জঘন্যতম মানবপাচার করে অবস্থা ফিরিয়ে নিয়েছে যারা: বর্তমানে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বাংলাদেশি অভিবাসির গণকবর আবিষ্কার, মৃতপ্রায় শ শ বাংলাদেশিকে বন্দিশিবির থেকে উদ্ধার, পাচারমুখি মৃতপ্রায় হাজার হাজার বাংলাদেশিকে ইন্দোনেশিয়া-মালেশিয়ার উপসাগরে মানবেতরভাবে ভাসমান অবস্থায় আবিষ্কারের পর স্বরাস্ট্রমন্ত্রী মানবপাচারকারী দালালদের বিরুদ্ধে কড়াকড়ি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি বার বার ব্যক্ত করায় এ অঞ্চলের দালালরা রাতারাতি গা ঢাকা দিয়েছে। এদের অধিকাংশ ঢাকা, চিটাগাংসহ বিভিন্ন স্থানে গাঢাকা দিয়েছে। তাদেরকে আর এলাকায় দেখা যাচ্ছে না বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেছে। শুধু যে দেখাই যাচ্ছে না তাই নয়, তারা নিজেদের মোবাইলফোনের সিমও পরিবর্তন করে নিয়েছে। ফলে তাদের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হওয়া এখন অনেকটাই শক্ত হয়ে পড়েছে।