আয় ও ব্যয়ের কোনো লক্ষ্যই অর্জিত হচ্ছে না

স্টাফ রিপোর্টার: চলতি অর্থবছরেও বরাবরের মতো আকাঙ্ক্ষার চেয়ে কম আয় করছে সরকার। বছরজুড়েই আয়ের লক্ষ্য অর্জনের পেছনে ছুটেছে সরকার। কিন্তু লক্ষ্য পূরণ করা যায়নি। এটা সরকারের জন্য বড় দুশ্চিন্তা হওয়ার কথা ছিল। তবে মন্দের ভালো হলো, আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী টাকাও খরচ করতে পারেনি সরকার। এতে অবশ্য কিছুটা স্বস্তি এসেছে। ব্যয় করতে না পারায় আয়ে টান পড়লেও সমস্যা হচ্ছে না।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা খরচের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৯ দশমিক ৭ শতাংশের জোগান দিতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। এনবিআর-বহির্ভূত কর ও কর ব্যতীত রাজস্ব থেকে আসবে আরও সাড়ে ১১ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ ঋণ ও বিদেশি সহায়তা দিয়ে বাজেটের বাকি ঘাটতি মেটানো হবে। বাজেটে সবচেয়ে বড় অর্থের জোগান দেয় এনবিআর। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসেই (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সব মিলিয়ে মূল বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব ঘাটতি ৩৫ থেকে ৩৮ হাজার কোটি টাকা হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

অন্যদিকে সরকারের অন্যতম বড় খরচের জায়গাটি হলো বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)। প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বাস্তবায়ন মাত্র ৫৫ শতাংশ। খরচ হয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছর শেষ হওয়ার আর মাত্র দুই মাস বাকি থাকলেও ছয়টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বরাদ্দের তিন ভাগের এক ভাগও খরচ করতে পারেনি। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সরকারি কর্মকমিশনের টাকা খরচের খাতা শূন্য।

সরকার বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প বা এডিপি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই উন্নয়ন ব্যয় করে। এবার মোট বাজেটের এক-তৃতীয়াংশের সমান এডিপি। বাকি অর্থ খরচ করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, দেশি-বিদেশি ঋণ পরিশোধে। আয় না করলেও সরকারকে এ অনুন্নয়ন ব্যয় করতেই হয়।

প্রতিবছর বিশাল বাজেট দেয়া হলেও যেমন খরচ করা যাচ্ছে না, তেমনি আয় হচ্ছে না। এতে প্রতিবছর বাজেটের আয়-ব্যয়ের হিসাব শুধু ‘সংখ্যায়’ বাড়ছে। বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বড় বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা যেমন গড়ে ওঠেনি, তেমনি বড় আয়ের সুযোগ ও দক্ষতাও তৈরি করা যায়নি। এর বড় উদাহরণ হলো মন্ত্রণালয়গুলোর পারদর্শিতা না বাড়লেও এডিপিতে গত ৫ বছরে ২২৫ প্রকল্প বেড়েছে। আর রাজস্ব আদায়ের জন্য সে ধরনের আইনি ও প্রশাসনিক সংস্কারও গত এক দশকে খুব বেশি হয়নি।

বাজেট ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, প্রতিবার বাজেটে আয়-ব্যয়ের যে লক্ষ্য দেয়া হয়, তা বস্তুনিষ্ঠ নয়। তাই লক্ষ্যও অর্জিত হয় না। এনবিআর লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না, এটা আগেই বলেছিলাম। তবু এবার এনবিআরের পারফরম্যান্স ভালো, ২০ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি আছে। নতুন অর্থবছরে যে বিশাল লক্ষ্য দেয়া হচ্ছে তা অর্জন করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। অন্যদিকে বিশাল এডিপি বাস্তবায়নের মতো প্রশাসনিক দক্ষতাও নেই। তবু বছর বছর বিশাল এডিপি নেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, এই বিশাল বাজেটের কথা বলে রাজনীতিবিদেরা হয়তো কিছুটা ‘পলিটিক্যাল মাইলেজ’ পান। সাংসদেরা এলাকায় গিয়ে বলতে পারেন, মানুষের জন্য এত এত প্রকল্প নিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে যথাসময়ে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় না।

রাজস্ব আদায়: চলতি অর্থবছরে এনবিআরকে ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রথম আট মাসে (জুলাই-মার্চ) সময়ে ১ লাখ ২৬ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। ওই সময়ে রাজস্ব ঘাটতি প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা। এ জন্য চলতি বছরে এনবিআরের সংশোধিত রাজস্ব লক্ষ্য দেয়া হয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত গড়ে প্রতি মাসে সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা করে রাজস্ব আদায় করতে হবে।

তবে এনবিআরের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি মোটামুটি সন্তোষজনক। সর্বশেষ মার্চ মাস পর্যন্ত প্রায় ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বছরের শুরুতে এনবিআরকে প্রায় ৩১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেয়া হয়। এনবিআর কখনো রাজস্ব আদায়ে এত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সামষ্টিক অর্থনৈতিক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলেছে, চলতি অর্থবছরে মূল লক্ষ্য থেকে ৩৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি হতে পারে। এর মানে হলো সংশোধিত লক্ষ্য থেকেও প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি থাকবে। এ অবস্থায় আগামী অর্থবছরের জন্য এনবিআরকে ২ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য দেয়া হচ্ছে।

উন্নয়ন বাজেট: চলতি অর্থবছরে মূল এডিপির আকার কমানো হয়নি। আগের মতোই ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা রয়ে গেছে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়সহ এডিপির আকার ১ লাখ ১৯ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। নির্বাচনের আগের বছরে সরকারের উন্নয়ন খরচের প্রবল ইচ্ছা থাকলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। কাঙ্ক্ষিত খরচ করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। চলতি অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সময়ে এডিপির প্রায় ৫৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৬৫ হাজার ৮৩ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৫১ শতাংশ। টাকার অঙ্কে ৪৭ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। এই সময়ে ২৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের বরাদ্দের অর্ধেক টাকাও খরচ করতে পারেনি। তবে বছরের বাকি দুই মাসে প্রতি মাসে গড়ে ২৭ হাজার টাকার বেশি খরচ করতে হবে। তাড়াহুড়ো করে প্রতিবারই শেষ সময়ে এডিপির টাকা খরচ করা হয়। এতে প্রকল্পের মান যথাযথ রাখা যায় না।