আলমডাঙ্গায় ৪ বছরে অর্ধেকে নেমেছে ধানচাষ

 

রহমান মুকুল: লাগাতার তেলের মূল্য, দফায় দফায় বিদ্যুত বিল, সার-কীটনাশকসহ কৃষি উপকরণের সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধি, বিভিন্ন প্রতিকূলতা ও বাজারে ধানের মূল্য ক্রমশ নিম্নগামী হওয়ায় এ বছর আলমডাঙ্গায় ইরি-বোরো চাষ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। কৃষকরা ধানচাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ক্রমেই ভুট্টা ও তামাকচাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

আলমডাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকদের সাথে আলোচনা করে জানা যায়, ধানচাষে অব্যাহত লোকসান কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের নাভিশ্বাস অবস্থা। বাধ্য হয়েই ধান চাষের ঐতিহ্য বিসর্জন দিয়ে তাদের আবাদ তালিকায় পরিবর্তন অব্যাহত রাখতে হচ্ছে। এরপরও সামাল দিতে পারছেন না দুরবস্থা। ধানচাষে তারা অব্যাহতভাবে মার খেয়েই চলছেন। সবকিছুর বাজার ঊর্ধ্বমুখী হলেও কেবল ধানের বাজার কমতির দিকেই। ফলে কৃষক তার উত্পাদন খরচ কোনোভাবেই তুলতে পারছেন না। তাই লোকসান কাটিয়ে উঠতে তারা বোরোর জমিতে  ভুট্টা, তামাক, সরিষা ও ডাল জাতীয় ফসল চাষে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এসব ফসল আবাদ থেকে তারা গেলো রোপা-আমনের লোকসান কাটিয়ে উঠতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরপরও জেনে শুনে বিষ পানের মতো লাগাতার আর্থিক ক্ষতি মেনে নিয়েই অনেক গোড়া কৃষক ঐতিহ্য রক্ষায় রোরো ধানচাষে মাঠে নেমেছেন। কিন্তু সম্প্রতি বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম নতুনভাবে বেড়ে যাওয়ার খবরে তারা সম্পূর্ণভাবে হতাশ হয়ে পড়েছেন। এলাকার প্রান্তিক চাষিদের অভিযোগের অন্ত নেই। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, সারের দাম বৃদ্ধি, সেচখরচ বৃদ্ধি, হালচাষের ট্রাক্টরের ভাড়া বৃদ্ধি, মজুরি বৃদ্ধি, কীটনাশকের মূল্য বৃদ্ধিতে দিশেহারা কৃষক। সর্বোপরি কৃষি কাজে বেশি টাকা খরচ করেও সময়মতো শ্রমিক না পাওয়া আরেক সমস্যা।

আলমডাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে জানা গেছে, উপজেলায় মোট ১১টি গভীর নলকূপ রয়েছে। অগভীর নলকূপের সংখ্যা ১৭ হাজার ২৫০। বিদ্যুতচালিত নলকূপগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অকেজো হয়ে আছে। ফলে সেই অকেজো নলকূপের আওতাধীন জমির কৃষকরা মহা ফাঁপড়ে পড়েছেন। ডিজেলচালিত অধিকাংশ নলকূপের মালিক কৃষকদের অবস্থা আরো নাজুক। দফায় দফায় ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস অবস্থা তাদের। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে তারা আরও বেশি বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। বোরো মরসুমে সারাদেশের মতো আলমডাঙ্গায়ও সেচ সঙ্কট দেখা দেয়। সেচ সঙ্কটের কারণে সময়মতো জমিতে পর্যাপ্ত পানি দিতে না পেরে বিদ্যুতচালিত সেচযন্ত্রের আওতাধীন বোরো আবাদ হুমকির মধ্যে পড়ছে।

কৃষকরা জানান, মাঘ মাস থেকে বোরো ফসল আবাদ শুরু করতে হয় এবং চৈত্রের প্রথম দিকে শেষ হয় বোরো আবাদ। ঋতুপ্রকৃতির বৈচিত্রে ঠিক এ সময়ে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ দেয়ার প্রধান মাধ্যম গভীর নলকূপগুলোর ওপর কৃষকরা নির্ভরশীল হলেও নানা জটিলতায় বর্তমানে অনেক গভীর নলকূপ অকার্যকর অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে বোরো চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। জিকে সেচ প্রকল্পধীন ও বিদ্যুতচালিত সেচ প্রকল্পধীন সমিতিগুলোর আভ্যন্তরীণ কোন্দল, বকেয়া বিদ্যুত বিল, ব্যাংক ঋণসহ নানা ধরনের সঙ্কটে অনেক চাষি বিপর্যস্ত। অধিকাংশ অগভীর নলকূপ ডিজেলচালিত হওয়ায় খরচ পোষাতে হিমশিম খাচ্ছেন কৃষকরা। সব মিলিয়ে অপর্যাপ্ত সেচ ব্যবস্থা আর সেচ সঙ্কটের কারণেও আলমডাঙ্গার কৃষকরা বোরো চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে। যে সকল কৃষক বোরো ধান রোপণ করেছেন তাদের চোখে-মুখে এখন রাজ্যের হতাশা জমাট বাঁধছে।

মূলত, এমন হতাশাগ্রস্ত কৃষকরা ধানচাষে আগ্রহ হারিয়ে ঝুঁকছেন ভুট্টা, তামাক, সরিষা, ডাল, গমসহ অন্যান্য আবাদের প্রতি। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের হিসাবমতে মাত্র ৪ বছরে উপজেলায় প্রায় ৫ হাজার হেক্টর ধানী জমিতে ভুট্টাচাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরে উপজেলায় ভুট্টাচাষ হয়েছিলো ৮ হাজার হেক্টর। ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১২ হাজার ৮০০ হেক্টরে। এ চিত্র ভয়াবহ। এছাড়া ক্রমাগতভাবে উপজেলায় তামাকচাষ বেড়ে চলেছে। ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে মোট ৪৫০ হেক্টর জমিতে তামাকচাষ দেখানো হলেও বাস্তব চিত্র অনেক বেশি হতাশার। ক্রমাগত সবুজ ধানক্ষেত বিলীন করে পরিবর্তে তামাকচাষে বিপর্যস্ত করা হচ্ছে পরিবেশ। তামাক উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা টোব্যাকো, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিটিসি), আকিজ কোম্পানির বিভিন্ন আর্থিক প্রলোভনে পড়ে প্রান্তিক চাষিরা তামাকচাষের দিকে ঝুঁকছেন। আর এতে ফসলি জমির ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। বিভিন্ন টোব্যাকো কোম্পানির উৎসাহ, সহজ শর্তে ঋণ, সার, কীটনাশক ও আনুষঙ্গিক কৃষি সরঞ্জামের সহজলভ্য করে দেয়ার কারণে এলাকার কৃষকেরা তামাকচাষে ঝুঁকছেন অধিকহারে। অথচ জমিতে তামাকচাষের ফলে কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, তামাক কোম্পানির প্যাকেজে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে সাধারণ কৃষক, আর ফসলি জমি হারাচ্ছে উর্বরাশক্তি। তামাকচাষে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে ,পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য পরিস্থিতিও পড়ছে হুমকির মুখে। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে হারিয়ে যাচ্ছে জমির উর্বরাশক্তি।

গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় আলমডাঙ্গার রোয়াকুলি ও বণ্ডবিল গ্রামের বেশ কয়েকজন কৃষকের সাথে আলাপ হয়। সে সময় কেন তারা ধানচাষের পরিবর্তে তামাকচাষ করছেন এমন প্রশ্ন করলে তাদের কণ্ঠে একই কথা প্রতিধ্বনিত হয় ধানচাষে লোকসান বেশি। মোটেও লাভ নেই। খালি খালি বেগার খাটা। তামাকচাষে নিরুৎসাহিত করতে তাদের গ্রামে কোনো এনজিও কিংবা সরকারি সংস্থা কাজ করছে কি-না তাও বলতে পারেননি তারা।

মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে উপজেলায় ধানচাষ হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৬ হাজার হেক্টর। এ তথ্য স্বয়ং উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের। প্রকৃত অবস্থা আরও হতাশাব্যঞ্জক বলে অনেকেই মনে করেন। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপাত্ত থেকে জানা যায়, ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরে উপজেলায় বোরো ধানচাষ করা হয়েছিলো ১৫ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে। বর্তমানে ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে তা কমে দাড়িয়েছে মাত্র ৯০ হাজার ৪০০ হেক্টরে।