মেহেরপুরবাসী সোনালি ধান চায় না; চায় রূপালি মাছ

মহাসিন আলী: মেহেরপুর জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত ভৈরব নদ এখন একটি মরা খাল। এ সুযোগে এক শ্রেণির দখলদার ইচ্ছেমতো ভৈরব নদের দু পাড় দখল করে ধানচাষ করছে। উৎপাদিত হচ্ছে সোনালি ধান। এতে দখলদাররা লাভবান হলেও সরকার হারাচ্ছে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব। কিন্তু ভৈরবপাড়ের মানুষ চায় ভৈরব খনন। যেখানে চাষ হবে রূপালি মাছ। উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরবে সবাই। এছাড়া ভৈরবের দু পাড়ের লক্ষাধিক কৃষক মরসুমি ফসল ফলাতে জমিতে পানি সেচ দিতে চায় ভৈরব থেকে। সকলে দাবি তুলেছে ভৈবর খননের। একাধিক সংগঠন শুরু করেছে ভৈরব খননের আন্দোলন।

ভৈরব নদের উৎসস্থল ভারতের গঙ্গা নদীর শাখা জলাঙ্গি নদী। মেহেরপুর জেলার শুভরাজপুর-কাথুলী সীমান্ত দিয়ে ভৈরব নাম ধারণ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এ নদ। এ নদের প্রবেশ মুখে ভারতীয়রা জলাঙ্গী নদীতে বাঁধ দেয়ায় তার পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দিন দিন ভৈরব নদ তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। এতে নষ্ট হয়েছে মেহেরপুরের পরিবেশ। প্রশাসনের হস্তক্ষেপ না থাকায় প্রতিনিয়ত প্রভাবশালী ও দু পাড়ের মানুষ ইচ্ছেমতো দখল করে নিচ্ছে নদ। দখলের সীমা এতোটায় ছাড়িয়ে গেছে যে, নদের মাঝ দিয়ে পানি প্রবাহের নালাটুকুও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। মেহেরপুর জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত প্রায় ৫০ কিলোমিটারের ভৈরব নদের দু পাড়ের প্রায় ২২ হাজার হেক্টর জমি প্রভাবশালীরা দখল নিয়ে মাটি ভরাট করে বোরো ধানচাষ করছে। এক্ষেত্রে সরকার তাদের নিকট থেকে কোনো রাজস্ব আদায় করতে পারছে না।

ভৈরবপাড়ের বন্দর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন জানান, এক সময় ভৈরব নদই ছিলো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবসায়ীদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। বড় বড় বজ্রা নৌকাসহ বিভিন্ন নৌযান চলতো এ নদ দিয়ে। এ সুবাদে জেলার গাংনী উপজেলার কাথুলী ও মেহেরপুর শহরের উপকণ্ঠের এ স্থানে নৌ-বন্দর স্থাপিত হয়েছিলো। সেই নৌ-বন্দর হারিয়ে গেলেও সেখানেই বন্দর নামের এ গ্রাম গড়ে উঠেছে। সেই সব স্মৃতি এলাকার মানুষের মন থেকে দিন দিন মুছে যাচ্ছে। ভৈরব নদ পুনর্খনন করা না হলে আর ১৫-২০ বছর পর আগামী প্রজন্ম বিশ্বাসই করতে চাইবে না যে মেহেরপুরে ভৈরব নদ বলে কোনো নদ ছিলো।

ভৈরবপাড়ের গোভীপুর গ্রামের বাসিন্দা হায়দার আলী জানান, এক সময় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দেশি মাছের একমাত্র ধারক ও বাহক ছিলো ভৈরব নদ। ভৈরব নদের এ করুণ দশায় নদপাড়ের কয়েক হাজার মৎস্যজীবী তাদের পেশা থেকে ছিটকে পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এর করুণদশায় দেশি মাছের অনেক মাছ এ অঞ্চল থেকে বিলুপ্তির পথে। ২শ প্রজাতীর দেশি মাছের স্বাদ পেতে এলাকার মানুষ এখনও এ নদের কাদা হাতড়ে বেড়ায়। দেশি মাছের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার সাধারণ মানুষ। যে সময় এ নদের যৌবন ছিলো তখন এলাকার সাধারণ মানুষের মাছের চাহিদার সব টুকুই পূরণ হতো। এখন এ এলাকার মানুষ ধান বেছে মাছ কিনে খায়।

ভৈরব নদকে পুনর্খনন ও দখলমুক্ত করতে বিগত সব সরকারই উদ্যোগ নিয়েছে কিন্তু অদ্যবদি এর কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। মাপ হয়েছে অনেকবার। পরিকল্পনা করা হয়েছে পুনর্খননের। এ পর্যন্তই শেষ। আশ্বাসের বাণী শুনেই এলাকার মানুষকে তৃপ্ত থাকতে হয়েছে বারবার। এ জেলার মানুষ আবারও ফুঁসে উঠেছে। দাবি তুলেছে ভৈবর খননের। একাধিক সংগঠন শুরু করেছে আন্দোলন। মেহেরপুরের মৃত্তিকা সংগঠন ভৈরব বাঁচাও আন্দোলন করছে। ভৈরব প্রতীকি খনন করেছে মেহেরপুরের যুগান্তর স্বজন সমাবেশ। তারপরও কোনো কাজ হয়নি।

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড চুয়াডাঙ্গার নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, ভৈরব নদ পুনর্খননের ডিজাইন অনুমোদিত হয়েছে। এছাড়া ৭ হাজার ৩৮২.৮৪ লাখ টাকার একপি ডিপিপি অনুমোদনের জন্য বোর্ডে পাঠানো হয়েছে।

মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য প্রফেসর ফরহাদ হোসেন দোদুল বলেন, কৃষি নির্ভর ও সবজিচাষ খ্যাত মেহেরপুর জেলায় আগামী ৫ বছরে নতুন নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষির উন্নয়ন ঘটিয়ে খাদ্যের উদ্বৃত্তি আরও বাড়ানো হবে। ভৈরব নদ খননের মাধ্যমে জমিতে কৃষি জমিতে সেচ ব্যবস্থাসহ মৎস্য চাষের উপযোগী করা হবে। এছাড়াও ভৈরব পাড়ে ইকো পার্ক তৈরি করে শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা করা হবে।