ছোট্ট দুর্ঘটনা : ভয়ঙ্কর পরিণতি মেধাবী কলেজছাত্রী পুষ্পের

 

আহাদ আলী মোল্লা: ছোট্ট দুর্ঘটনা। কিন্তু ভয়ঙ্কর পরিণতির শিকার হয়েছেন পুষ্প। শুধু মুখের কথা ছাড়া জীবনে কোনো কিছুই তার অবশিষ্ট নেই। অসাড় দেহ বিছানায় এলিয়ে দিয়ে এক অজানার দিকে চেয়ে আছেন তিনি। বিছানায় এ পাশ ও পাশ করাতো দূরের কথা দেহের কোনো অঙ্গ নড়ানোর মতো ক্ষমতা তার নেই। একমাত্র মা-ই তার জীবনসঙ্গী। পৃথিবীর রঙ, রূপ আর ছন্দ সব এলোমেলো করে দিয়েছে ছোট্ট একটা দুর্ঘটনা। কলেজের মেধাবী ছাত্রী পুষ্প কেঁদে কেঁদে বলেছেন আমার মতো এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা যেন পৃথিবীর আর কারো না হয়। ঠিক এক বছর আগের ঘটনা। ২০১৫ সালের ১৪ জুন। সকালে কলেজের উদ্দেশে রওনা দেন মেধাবী ছাত্রী পুষ্প। সকাল ৬টা ২০ মিনিটে তার জীবনে নেমে আসে এক অন্ধকার।

পুরো নাম মিফতাহুন জান্নাত পুষ্প। তিনি চুয়াডাঙ্গা দৌলাতদিয়াড় বঙ্গজপাড়ার ইয়াছিন আলী ও ছালমা আক্তারের একমাত্র মেয়ে। লেখাপড়ায় বরাবরই তিনি ভালো। চুয়াডাঙ্গার রাহেলা খাতুন গার্লস একাডেমি থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ২০১২ সালে তিনি ৪ দশমিক ৬৩ জিপিএ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। পরে ২০১৪ সালে চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ৪ দশমিক ৩০ জিপিএ নিয়ে এইচএসসি পাস করেন। ২০১৫ সালে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে রসায়ন বিভাগে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হন।

পুষ্পের বাবা ইয়াছিন আলী একটি লাইফ ইনস্যুরেন্সে সামান্য বেতনে চাকরি করেন। মা গৃহিণী হলে সংসারের কথা চিন্তা করে বাড়িতে দর্জির কাজ করেন। তাদের ইচ্ছে ছিলো মেয়ে পুষ্প আর ৭ম শ্রেণিতে পড়া ছেলে সাকিব হাসান পাপ্পুকে মানুষ করতে পারলেই তাদের দায়িত্ব শেষ। সেভাবেই এগোচ্ছিলেন পুষ্প। কিন্তু এরই মধ্যে ঘটে যায় মর্মান্তিক ঘটনা।

২০১৫ সালের ১৪ জুন। সেদিন ছিলো রোববার। রোজা আসতে আর মাত্র ৫দিন বাকি। একই ক্লাসে ভর্তি হওয়া বান্ধবী মুসলিমা খাতুনের সাথে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের উদ্দেশে রওনা দেন। প্রথমে ওঠেন ইজিবাইকে। সকাল ৬টা ২০ মিনিটে ইজিবাইকটি চুয়াডাঙ্গা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে পৌঁছুলে ইজিবাইকের চাকার শ্যাপে তার ওড়না জড়িয়ে যায়। গলায় ফাঁস লেগে সমস্ত শিরা-উপশিরা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। চুয়াডাঙ্গা থেকে, ঢাকা, তারপর ভারত। দীর্ঘ কয়েক মাস হাসপাতালে কাটে তার। কিন্তু না। কোনো কিছুতেই কিছু হয় না। ডাক্তাররা জানিয়ে দেন তার স্পাইনাল কড ড্যামেজ হয়ে গেছে। বিশ্বের কোথায়ও এর চিকিৎসা নেই। পুষ্প এখন অথর্ব। শুধু গলা থেকে মাথা পর্যন্ত তার ঠিক আছে। আর পুরো শরীর অনুভূতিহীন। পুষ্প জানিয়েছেন, আমার গলা থেকে পা পর্যন্ত অবশ। আমি চলাফেরাতো দূরের কথা নড়াচড়াও করতে পারিনে। শুধু মুখের কথা ছাড়া আজ আমার আর কিছুই নেই। পুরো এক বছর ধরে বিছানায় পড়ে থেকে যে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করছি, সেটা কি শুধু আমার বা আমার কপালের দোষ। না কি সেই অসচেতন অসাধু ইজিবাইক চালকের দোষ। যিনি তার গাড়ির ইঞ্জিন কভার না লাগিয়ে রাস্তায় গাড়ি বের করলেন? জানি না কার দোষ, কিন্তু ভুক্তভোগী শুধু আমি, আর আমার পরিবার। বেঁচে থেকেও আজ আমি মৃত। তবু আশায় বুক বেঁধে আছি। একদিন আমার জীবনের সকল অন্ধকার দূর হয়ে সোনালি সূর্য উঁকি দেবে। আমি সুস্থ হয়ে উঠবো। জীবন সম্পর্কে বুঝে ওঠার আগেই, আমার এই করুণ পরিণতি আমার ও আমার পরিবারকে মেনে নিতে হয়েছে। তাই আমি আর চাই না এমন পরিণতি আর কারো জীবনে ঘটুক। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমার আকুল প্রার্থনা এইসব অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। দেশবাসী সকলের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করুন। যেন আর কোনো পুষ্পকে অবেলায় ঝরে যেতে না হয়। পুষ্প জানান, তার খুব ইচ্ছে ছিলো লেখাপড়া শেষে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দরিদ্র বাবা-মাকে আর কষ্ট করতে দেবো না। কিন্তু একটা দুর্ঘটনায় আমার স্বর্ণোজ্জ্বল সুন্দর ভবিস্যত জীবনকে অমাবশ্যার গাঢ় অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। যেন আজ আমার আশাগুলো হতাশা, আর স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

পুষ্পের মা ছালমা আক্তার কাঁদতে কাঁদতে জানান, আমাদের শেষ সম্বলটুকু দিয়েও চেষ্টা করেছি মেয়েকে সুস্থ করার। কিন্তু নিয়তির কাছে আমরা হেরে গেছি। একমাত্র নিকটজনরা ছাড়া কেউ আমাদের সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি। এখনও মেয়ের পেছনে খরচ করে চলেছি, কারণ সে যে আমার হৃদয়ের টুকরো।