কেরুজ চিনিকলের বিভিন্ন উন্নয়ন খাত পড়েছে মুখ থুবড়ে

জেনারেল অফিস ভবন নির্মাণসহ শত কোটি টাকার কাজ শুরু হবে কবে?
দর্শনা অফিস: এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় ও বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান দর্শনা কেরুজ চিনিকল। মিলটি চুয়াডাঙ্গা তথা এ অঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক চালিকশক্তি হিসেবে রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। জেলার ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর সরকারের খাতে রাজস্ব দিয়েছে শত শত কোটি টাকা। স্বাধীনতার পর সম্প্রতি সময়ে উন্নয়নের ছোয়া লেগেছে কিছুটা। শত কোটিরো বেশি টাকা কেরুজ চিনিকলের বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ দেয়ার কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তা ভিন্ন। এরই মধ্যে ৪ তলা বিশিষ্ট মিলের জেনারেল অফিস ভবন নির্মাণের জন্য প্রাথমিকভাবে ২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও দেড় বছরের ফাঁকা জমিতে ইটের টুকরোও পড়েনি। কবে নাগাদ ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হবে তা অনিশ্চিত। অন্যান্য বিভাগের বরাদ্দ কি লাল ফিতেই বন্দি হয়েই রয়েছে ? কেরুজ চিনিকলের নিজস্ব ৩ হাজার ৫শ ৫০ একর জমি থাকলেও চিনি ও ডিস্টিলারী কারখানা এবং আবাসিক এলাকা রয়েছে ৫১২ একর জমিতে। ১৮৪৭ সালে মি. রাবর্ড রাসেল কেরুজ অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে মদ কারখানার সাথে যুক্ত হন এবং কালক্রমে তা কিনে নেন। উত্তর ভারতের রোজাতে অবস্থাকালীন ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের সময় কারখানাটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরে তা পুণনির্মাণ করে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি গঠন করে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয়। রোজাতে ব্যবসায় উন্নতি লাভ করলে আসানসোলে ও কাটনিতে কোম্পানির শাখা প্রতিষ্ঠিত করা হয়। ১৯৩৮ সালে প্রাথমিকভাবে দৈনিক ১ হাজার টন আখ মাড়াই ও ১৮ হাজার প্রুপ লিটার স্পিরিট তৈরির লক্ষে আরও একটি শাখা ততকালীন নদীয়া জেলার বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনায় স্থাপন করা হয়। বর্তমানে ডিস্টিলারীতে প্রতি অর্থবছরে ৪৭ লাখ প্রুপ লিটার স্পিরিট উৎপাদন করা হচ্ছে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর কারখানাটি শত্রু সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছিলো। ১৯৬৮ সালে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি পাকিস্তান লিমিটেডের স্থলে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ইপিআইডিসির ওপর ন্যাস্ত করার সরকারি প্রচেষ্টা সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অকার্যকর হয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা পর প্রতিষ্ঠানটি জাতীয়করণ করা হয়। তখন থেকেই আজ পযন্ত কেরুজ চিনিকলটি বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে। ৭৯ বছর বয়সী পুরোনো এ মিলটির সম্প্রতিকালের অবস্থা নাজুকে পরিণত হয়েছে। জোড়াতালি দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছিলো মিলটির কার্যক্রম। সরকার এ মিল থেকে প্রতি বছর শ শ কোটি রাজস্ব আদায় করে আসছে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। অথচ সেকেলের নির্মাণ করা জরাজীর্ণ ভবনে জীবনের ঝুকিয়ে নিয়ে যেমনি চলছে অফিসের কার্যক্রম, তেমনি সেই পুরোনো আবাসিক কোয়ার্টারগুলোতেই পরিবার-পরিজন নিয়েই বসবাস করছে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য হাজি আলী আজগার টগরের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সরকারের সংশি¬ষ্ট মন্ত্রাণালয় থেকে ২০১২ সালে ৪৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মিলটিকে আধুনিকায়ন করণের জন্য। ২০১৩ সালের জুনে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস (বিএমটিএফ) আধুনিকায়নের কাজ শুরু করার কথা থাকলেও বিভিন্ন কারণে তা সম্ভব হয়নি। পরে ২০১৫ সালের ২৮ আগস্ট এ কাজ শুরু করা হয়। এখনো সম্ভুকগতিতে চলছে আধুনিকায়নের কাজ। কোন বছর নাগাদ শেষ হবে এ কাজ তা জানেনা কেউ। কেরুজ চিনিকলের জেনারেল অফিস ভবন নির্মাণের জন্য ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন। যে বরাদ্দের মধ্যে ২ কোটি টাকার অনুমোদন করা হয় নির্মাণ কাজ শুরুর জন্য। গত বছরের জুলাই মাসের শুরুতেই মিলের জেনারেল অফিসের ৪ তলা ভবন নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার কথা থাকলে সে জমিতে পড়েনি এক টুকরো ইট। ততকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দেয়া তথ্যে বলা হয়েছিলো করপোরেশন থেকে মিলের উন্নয়নের বিভিন্ন খাতে প্রচুর টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে, ১ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে ডিস্টিলারীর সয়ংক্রিয় মেশিন স্থাপন, ১ কোটি টাকা ব্যয়ে চিনি প্যাকেটজাতকরণ মেশিন, ১ কোটি টাকা ব্যয়ে দর্শনার প্রধান সড়ক ও বাজার ঘেষা জমিতে মার্কেট নির্মাণ, আকন্দবাড়িয়ার জৈব সার কারখানা উন্নয়নের জন্য ৩০ লাখ টাকা, মিলের গ্যারেজ সেডের জন্য, ব্যাংক, আরও একটি মার্কেট ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন খাতেও দেয়া হচ্ছে অর্থ বরাদ্দ। তবে বাজার মাঠ সংলগ্ন দ্বিতল মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। জেনারেল অফিসের ৪ তলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণের জন্য সে সময় স্থান নির্ধারণ ও জমি ভরাট সম্পন্ন করা হয়। আবাসিক এলাকা উচ্ছেদ করে বাউন্ডারি পাঁচিল নির্মাণের কাজ শেষ করা হলেও ভবনের জায়গা খালিই পড়ে আছে। জেনারেল অফিস ভবনের নকশা অনুযায়ী ১ম তলায় ইক্ষু বিভাগের কার্যালয়, ২য় তলায় মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কার্যালয়সহ প্রশাসন বিভাগ, ৩য় তলায় হিসাব বিভাগ ও ৪র্থ তলায় বিভিন্ন বিভাগের অফিস। মিলের এক একর জমিতে এ ভবন নির্মাণের ড্রইং ডিজাইন সম্পন্ন করা হয় সে সময়। ততকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বর্তমানে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের সচিব এবিএম আরশাদ আলী জানান, কেরুজ চিনিকলের বিভিন্ন বিভাগের উন্নয়নে ১শ কোটিরও বেশি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে কাজ শুরুর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ শুরু করা হবে। ওই মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সব বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৫১২ একর জমির ওপর কেরুজ কমপে¬ক্সের প্রচুর পরিমাণ জমি পরিত্যক্ত রয়েছে। বসবাসের অনুপযোগী মানধাক্তা আমলের পরিত্যক্ত ভবন, ঝোপঝাড়ের কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয় বসবাসকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। সেক্ষেত্রে পুরোনো অফিসার ও স্টাফ কোয়ার্টার ভেঙে এক স্থানে পরিকল্পনা মাফিক একাধিক বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলে একদিকে যেমন জমি ও অর্থ সাশ্রয়, অন্যদিকে নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে মিলের কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারী এবং পরিবার-পরিজনের বসবাস। এ বিষয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এনায়েত হোসেন বলেন, আমি নতুন এসেছি। এ বিষয়ে আমি কিছু জানিনা।