এবাদত বন্দেগিতে মুখর তুরাগ তীর

জুমার নামাজে লাখো মুসল্লি আজ যৌতুকবিহীন বিয়ে

স্টাফ রিপোর্টার: বিপুল ধর্মীয় উত্সাহ-উদ্দীপনা ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লির অংশগ্রহণে গতকাল শুক্রবার শুরু হয়েছে তাবলীগ জামাত আয়োজিত বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের জিকির-আসকার ও ইবাদত-বন্দেগিতে শিল্পনগরী টঙ্গীর তুরাগ তীরবর্তী বিশাল এলাকা এক পাক-পবিত্র পুণ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। গতকাল ইজতেমার প্রথমদিনে জুমার নামাজকে ঘিরে সকাল থেকেই তুরাগ তীরে মুসল্লিদের ঢল নামে। বিশাল জামাতে জুমার নামাজ আদায় করার জন্য টুপি-পাঞ্জাবি পরে জায়নামাজ হাতে রাজধানী ঢাকা এবং আশপাশের জেলা এমনকি দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন নানা বয়সী মানুষ। দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে এসেছেন অনেকে। তিলধারণের ঠাঁই ছিলো না ১৬০ একর জমিতে তৈরি বিশাল ছাউনির নিচে। জুমার নামাজ শুরুর আগে পুরো ইজতেমাস্থল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে জনসমুদ্রে পরিণত হয়। নামাজের কাতার ছাপিয়ে যায় নদীতীর, সড়ক-মহাসড়ক। বহু মুসল্লিকে জায়গা না পেয়ে রাস্তায় খবরের কাগজ, পলিথিন বিছিয়ে নামাজ আদায় করতে দেখা যায়। আয়োজকদের ধারণা, অন্য বছরের তুলনায় এ বছর আবহাওয়া অনুকূল থাকায় আনুমানিক ১৫ লক্ষাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করেছেন। বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে পুরো ময়দানকে ৪০টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। এতে দেশের ৩২টি জেলার মুসল্লিরা অংশ নিচ্ছেন। আগামীকাল রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হবে ১ম পর্বের ইজতেমা। এরপর দ্বিতীয় পর্ব ৩১ জানুয়ারি শুরু হয়ে শেষ হবে ২ ফেব্রুয়ারি। গতকাল শুক্রবার বাদ ফজর তাবলীগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বী পাকিস্তানের মাওলানা ইসমাইল হোসেনের আমবয়ানের মধ্যদিয়ে শুরু হয় বিশ্ব ইজতেমার ১ম পর্বের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। মূলমঞ্চ থেকে উর্দু ভাষায় প্রদত্ত তার বয়ান একইসাথে বাংলায় ভাষান্তর করেন স্বাগতিক বাংলাদেশের তাবলীগ মুরুব্বী মাওলানা মাহমুদ হোসাইন। জুমা নামাজের আগে বয়ান করেন বাংলাদেশের তাবলীগ মুরব্বী মাওলানা মোহাম্মদ হোসেন। জুমার নামাজে ইমামতি করেন ঢাকার কাকরাইল মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ যুবায়ের। এবার বিশ্ব ইজতেমার মূল মঞ্চের বাইরে তুরাগ নদীর পশ্চিম পাড়ে বিশেষভাবে স্থাপিত মঞ্চ থেকে জুমার নামাজের ইমামতি করা হয়। বাদ ফজর হতে মাগরিব পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে দেশ-বিদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ ঈমান, আমল ও দাওয়াত সম্পর্কে সারগর্ভ বয়ান করেন।
ভিআইপিদের জুমার নামাজ আদায় গতকাল ইজতেমা ময়দানে লাখো মুসল্লির সাথে বৃহত্তম জুমার নামাজে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক এমপি, প্রধান বিচারপতি তোফাজ্জল হোসেন, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নান, জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, জেলা প্রশাসক মো. নূরুল ইসলাম। গতকাল প্রথম পর্বের প্রথমদিনে বাদ ফজর ভারতের মাওলানা মো. ইসমাইল হোসেন, বাদ জুমা বাংলাদেশি মাওলানা মো. ওমর আলী, বাদ আছর ভারতের হযরত মাওলানা মো. জোবায়েরুল হাসান ও বাদ মাগরিব ভারতের হযরত মাওলানা সাদ বয়ান করেন। প্রথমদিনে বয়ানে আলেমগণ বলেন, যতোদিন দ্বীন থাকবে ততোদিন দুনিয়া থাকবে। আর দ্বীন টিকে থাকবে দাওয়াতের মাধ্যমে। যুগে যুগে নবী-রাসুলগণ দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করে গেছেন। ফেরাউনের কাছেও দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতে আল্লাহ হযরত মুসা (আ:) কে পাঠিয়েছিলেন। নবী-রাসুলদের আল্লাহ নিজের পরিবার ও বিভিন্ন গোত্রের মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। হযরত মুহাম্মদ (সা:) কে সারা দুনিয়ায় দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন। এ কাজের জিম্মাদারি এখন তার উম্মতের ওপর।

বিভিন্ন ভাষায় বয়ানের অনুবাদ বিশ্ব ইজতেমায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের তাবলিগ মারকাজের ১৫-২০ জন শুরা সদস্য ও বুজুর্গ বয়ান পেশ করবেন। মূল বয়ান উর্দুতে হলেও বাংলা, ইংরেজি, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফারসি ভাষায় তাত্ক্ষণিক অনুবাদ হচ্ছে। বিদেশি মেহমানদের জন্য মূল বয়ান মঞ্চের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বপাশে। বিভিন্ন ভাষাভাষী মুসল্লিরা আলাদা আলাদা বসেন এবং তাদের মধ্যে একজন করে মুরুব্বী মূল বয়ানকে তাত্ক্ষণিক অনুবাদ করে শুনান। দুই মুসল্লির মৃত্যু গত বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার দিকে ইজতেমায় আগত এক মুসল্লি টয়লেটে যাওয়ার পথে হঠাত পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারান। টঙ্গী হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিত্সক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার নাম আব্দুল মজিদ প্রামাণিক (৬৫)। বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার মধ্যমিটুবাড়ি এলাকায়। ১২নং নিজ খিত্তায় রাত ২টার দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন ওমর আলী (৪৮)। টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি মারা যান। তার বাড়ি ঢাকার কেরানীগঞ্জ থানার রুহিতপুর গ্রামে। শুক্রবার বাদ ফজর ও বাদ জুমা তাদের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমদিনে ৩০ হাজার বিদেশি মুসল্লির অংশগ্রহণ
প্রথম পর্বে ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, ব্রিটেনসহ বিশ্বের ১৩৩টি দেশের প্রায় ৩০ হাজার মুসল্লি অংশ নিয়েছেন। বিভিন্ন ভাষাভাষী ও মহাদেশ অনুসারে ইজতেমা ময়দানে বিদেশি মেহমানদের জন্য মোট ৩টি তাবু নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে। ৩ পকেটমারের কারাদণ্ড গতকাল ইজতেমা ময়দানে আটক তিন পকেটমারকে ভ্রাম্যমাণ আদালত ১০ দিনের দণ্ড প্রদান করেছে। দণ্ডপ্রাপ্তরা হচ্ছে বদি আলম (২৮), রাসেল (২৪) ও মারুফ ২৫। এছাড়া বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ইজতেমা স্থল ও আশপাশে অভিযান চালিয়ে ৫০-৬০ জন পকেটমারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইজতেমা স্থল ও আশপাশে খাবারের দোকান ও হোটেলে ভ্রাম্যমাণ আদালত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্য পরিবেশন ও ভেজাল খাদ্য বিক্রয়ের অভিযোগে খাবারের দোকান ও হোটেল মালিকদের বিরুদ্ধে ৯টি মামলা ও ১৫ হাজার ২০০ টাকা জরিমানা আদায় করেছে। তীব্র যানজট শুক্রবার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, কালীগঞ্জ সড়ক ও আশুলিয়া-সাভার সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বাস, মিনিবাস, ট্রাক, অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহন ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা পড়ে। লাখ লাখ মুসল্লি এ সময় হেঁটে ইজতেমাস্থলে আসেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে হিমসিম খেতে হয়েছে। টঙ্গী হাসপাতালে চিকিত্সাসেবা টঙ্গী হাসপাতাল ও সিভিল সার্জনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ৩টি মেডিক্যাল ক্যাম্পে ও টঙ্গী হাসপাতালে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত গত দু দিনে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ৩ হাজার ৯০ মুসল্লি প্রাথমিক চিকিত্সা নিয়েছেন। ১৪ জনকে টঙ্গী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। প্রায় অর্ধশত ফ্রি-মেডিক্যাল ক্যাম্পে কয়েক হাজার মুসল্লি চিকিত্সা নিয়েছেন। ওজু-গোসলের পানি ইজতেমা ময়দানে পানির অপ্রতুলতার কারণে মুসল্লিদের আশপাশ এলাকা থেকে ওজু ও গোসলের জন্য পানি ক্রয় করতে দেখা গেছে। ওজুর পানি ১০টাকা এবং গোসলের পানি ২০ টাকা দরে ক্রয় করেছেন। উত্তরা থেকে আসা আব্দুর রহমান জানান, ময়দান থেকে পানি সংগ্রহে কষ্টের কারণে বাহির থেকে ১০ টাকা প্রতি বদনা পানি ক্রয় করে ওজু করছি। জুমার নামাজ আদায় করতে মুসল্লিরা দু পাতার পুরাতন পত্রিকা দু টাকা করে ক্রয় করেছেন এবং এক গজ পলিথিন ২০ টাকা দরে কিনেছেন। আজ যৌতুকবিহীন বিয়ে ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী আজ শনিবার বাদ আসর শতাধিক যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে। সকাল থেকে বিয়ের জন্য বর-কনের নাম তালিকাভুক্ত করা হবে। গতকাল বিকেল চারটা পর্যন্ত বিবাহের জন্য ৫০ জনের নাম তালিকাভুক্ত রয়েছে।

হারানো ও প্রাপ্তি: ইজতেমা মাঠের পশ্চিম-উত্তর দিকে ‘হারানো ও প্রাপ্তি সেন্টার’ খোলা হয়েছে। ময়দানে কেউ কিছু হারালে ও কিছু পাওয়া গেলে সেখান থেকে সঠিক তথ্য প্রদান করা হচ্ছে।