মেহেরপুর ও ঝিনাইদহে কামার শালায় ব্যস্ততা : কসাইদের কদর

গাংনী প্রতিনিধি: দরজায় কড়া নাড়ছে ইদুল আযহা। কোরবানির পশু বেচনাকেনা চলছে ধুমছে। সমানতালে চলছে পশু কোরবানির প্রস্তুতি। মেহেরপুর গাংনীর কামারশালায় দিনরাত ব্যস্ততা। অন্যদিকে বেড়েছে কসাইদের তোড়জোড়। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে এখন গাংনীর কসাইদের ব্যাপক কদর। বাড়তি রোজগারের উদ্দেশে সেখানে পশু জবাই ও মাংস তৈরির বুকিং প্রায় শেষ।

হাতুড়ির ঠুকঠাক আর হাপরের হাসফাস শব্দে মুখরিত কামারশালা এলাকা। কামারদের কেউ হাপর টানায় ব্যস্ত আবার কেউ ইস্পাত পুড়িয়ে হাড়-ড়িপেটা করে নির্দিষ্ট অস্ত্রপাতি তৈরি করছেন। কাজ নিয়ে আগত লোকজনের কেউ কেউ আনমনে চেয়ে আছেন এই কঠিন কাজের দিকে। দিনরাতের যেকোন সময় কামারশালার পাশ দিয়ে গেলেই বোঝা যাবে কামারদের ব্যস্ততার শেষ নেই। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে দা, ছুরি, চাপাতি, কুড়ালসহ পশু জবাই ও মাংস তৈরির অস্ত্রের কাজ। একই সাথে পুরাতন অস্ত্রপাতি পুড়িয়ে ধারালো করতেও ব্যস্ত কামাররা।

গাংনী কাঁচা বাজার সংলগ্ন কামারশালার সত্ত্বাধিকারী সিদ্দিকুর রহমান ও কাওছার আলী জানান, অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার নতুন অস্ত্রপাতি তৈরির অর্ডার বেশি। পাশাপাশি পুরাতন অস্ত্রপাতি ধার দেয়ার কাজ চলছে সমানতালে। কাজের ব্যাপক চাপ থাকলেও কোরবানির পশু জবাই করার আগেই এগুলো স্ব স্ব মালিকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার আশা করছেন তারা।

গাংনী কাঁচা বাজারের ব্যবসায়ী নাজমুল হোসেন জানান, ঈদুল আযহার দিনে মুসলমান সমাজে পশু কোরবানির উৎসব। তাইতো কসাই সঙ্কট দেখা দেয়। তবে নিজ হাতে পশু কোরবানি ও মাংস তৈরিতে এক অন্যরকম তৃপ্তি। তাই নতুন অস্ত্রপাতি তৈরি ও ধার দিতে কামারশালায় এসেছি।

এদিকে কসাইদের এখন কদর বেশি। কোরবানির সময় মাংস বিক্রির তেমন হয়না বিধায় বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে থাকে কসাইদের। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে মাংস তৈরির কাজ করে থাকেন গাংনীর কসাইরা। সেখানকার মানুষজন আগে থেকেই কসাই বুকিং করে রাখছেন। দলগত ও ব্যক্তিগত উদ্যোগেও এখানকার মাংস তৈরির কাজে নিয়োজিতরা কাজ ধরছেন। ঈদের একদিন আগেই তারা এ লক্ষ্যে সেখানে পৌঁছেবেন।

গাংনী শহরের মাংস বিক্রেতা জাহাঙ্গীর আলম জানান, গাংনী শহরে অন্তত ৬০ জন কসাই রয়েছেন। এছাড়াও বিভিন্ন গ্রামে রয়েছেন আরও দুই শতাধিক। এদের প্রায় বেশিরভাগই ঢাকায় কাজ ধরেছেন। গরু কেনার মূল্যের প্রতি হাজারে দেড়শ টাকা ও ছাগল প্রতি ১ হাজার ৫শ টাকা খরচ নেয়া হয়। সব মিলিয়ে একেক জন কসাই মাংস তৈরী করে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকেন।

কালীগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কোরবানির পশু জবাইয় সংক্রান্ত উপকরণ ছুরি, পাতি, দা, বটিসহ বিভিন্ন ধারালো জিনিস তৈরিতে এখন ব্যস্ত ঝিনাইদহ জেলার  কালীগঞ্জ উপজেলার প্রায় ২ শতাধিক কামার। এসব ধারালো অস্ত্র চাহিদা মতো সরবরাহে কামার শিল্পীরা দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন। ঈদ যতো ঘনিয়ে আসবে বিক্রি ততো বেশি হবে বলে জানান তারা।  আশির দশকের শুরু থেকে এখানে ব্যবসা শুরু করেছেন দা, বটি, চাপাতি তৈরির কারিগররা। কোরবানী পশু জবাই করার অন্যতম উপাদান এসব পণ্য। বছরের অন্য সময়ের চেয়ে কোরবানির সময়টাতে কাজের চাপ অনেক বেড়ে যায়। সেই সাথে বেড়ে যায় তাদের আয়-রোজগারও। সারাবছর তাদের দুর্দিন থাকলেও এখন অনেকটাই সুদিন। গতকাল দুপুরে  কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার , রায়গ্রাম , নলডাংগা , দুধরাজপুর , সুন্দরপুর কামারপট্টি ঘুরে দেখা যায়, পশু কোরবানির নানা উপকরণ তৈরিতে ব্যস্ত কামাররা। উপজেলার প্রায় ২ শতাধিক কামাররা ব্যস্ত সময় পার করছেন।

ঝিনাইদহের  কালীগঞ্জ থানা রোডের বিভিন্ন কামারের দোকান ঘুরে জানা যায়, বর্তমানে প্রতি পিস বটি পাইকারী ২শ, খুচরা ২৫০-৩শ, চাপাতি পাইকারী ৩৫০, খুচরা ৫শ, ছুরি সর্বনিম্ন ৬০ এবং সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে পশু জবাই করার ছুরি ৬শ থেকে এক হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বছরে একবারই চাপাতি, ছুরি, বটির চাহিদা বেশি থাকে। এজন্য আগে থেকেই এগুলোর মজুদ করে রাখে তবে কামারপট্টির কারিগর অভিযোগ করেন, তাদের পরিশ্রমের তুলনায় মজুরি অনেক কম। সারাদিন আগুনের পাশে বসে থাকতে হয়। ফলে বিভিন্ন ধরেনের সমস্যা শরীরে তৈরি হয়। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অভাবে কমে যাচ্ছে কামার সম্প্রদায়। বাধ্য হয়ে পৈত্রিক পেশা পরিবর্তন করছে অনেকে।

ব্যবসায়ী ফটিক বাবু  প্রতিবেদকে  জানান, সারাবছর তৈরি করা এসব পণ্য যতো বিক্রি হয় তার চেয়ে বেশি বিক্রি হয় ঈদ মরসুমে। শুধুমাত্র কোরবানির সময়টাতে এসব পণ্য ভাল চলে। বাকি সময়টাতে ব্যবসা ভালো চলে না। ফলে সামান্য লাভে বিক্রি করতে হচ্ছে।

এদিকে লোহা ও কয়লার দাম বাড়লেও সে তুলনায় কামার শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়েনি। এছাড়া আধুনিকতার ছোঁয়ায় এসব পণ্য তৈরির বেশ কিছু আবার প্রযুক্তি নির্ভর হাওয়ায় কামার সম্প্রদায় আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়ছে। এ কারণে অনেকে বাধ্য হয়ে পৈত্রিক পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন বলে জানা যায়। এ ব্যাপারে কালীগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সহসাধারণ সম্পাদক সদর উদ্দীন জানান, কামার শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।

 

 

Leave a comment