ক্ষমতাসীনদের ছাড়াই বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের চেষ্টা চালাবে বিএনপি

 

স্টাফ রিপোর্টার: সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে প্রয়োজনে ক্ষমতাসীনদের ছাড়াই দেশে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা চালাবে বিএনপি। এ লক্ষ্যে একটি রূপরেখা চূড়ান্ত করছে দলটির হাইকমান্ড। জাতীয় ঐক্য গঠনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর বিএনপি ধরে নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা তাদের জাতীয় ঐক্যের প্রস্তাব গ্রহণ করছে না। এমনকি ১৪ দলের অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও ঐক্যের প্রস্তাবে সাড়া দেয়ার সম্ভাবনা কম।

জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে জাতীয় ঐক্য গঠন নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি একটু বেকায়দায় থাকলেও দলের শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে প্রয়োজনে জামায়াতকে বাইরে রেখে হলেও জঙ্গিবাদ, দেশের নিরাপত্তা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের স্বার্থে একটি জাতীয় ঐক্য গড়তেই হবে। গুলশান কার্যালয় ও বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে জাতীয় ঐক্য গঠনে বিএনপি দলমত নির্বিশেষে একটি জাতীয় কনভেনশন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সাথে একই ইস্যুতে জনমত গঠনে বৃহত্তর ১৯ জেলায় সমাবেশ করার পরিকল্পনাও রয়েছে দলটির। তবে কবে থেকে এসব সমাবেশের কর্মসূচি দেয়া হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। জানা গেছে, লন্ডন থেকে ফিরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রক্রিয়া ও কর্মসূচির বিষয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আবারো আলোচনা শুরু করবেন। মির্জা ফখরুল বর্তমানে লন্ডনে লর্ডস অব হাউজের একটি সেমিনারে বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

গুলশান কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে বিএনপি দলগতভাবেই উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করবে। পর্যায়ক্রমে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া অন্য রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন। একই সঙ্গে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে ক্ষমতাসীন সরকারের জাতীয় ঐক্য গঠনে চাপ সৃষ্টি করারও পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির।

১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে অস্ত্রধারীদের হামলায় ১৭ বিদেশিসহ ২২ জন নিহত হওয়ার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনে দেশের সর্ববৃহৎ ঈদের জামাত কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলার পর বিএনপির পক্ষ থেকে উগ্রপন্থা দমনে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তার দল ও জোটের করণীয় নির্ধারণ করতে শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে গুলশানের আর্টিজান ক্যাফে ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়। একই সাথে ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে দলমত নির্বিশেষে একটি জাতীয় ঐক্য গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই সাথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দেয়ারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসেম সম্মেলন থেকে ফিরে রোববার গণভবনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী বিএনপির জাতীয় ঐক্যের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করলেও বলেছেন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে জাতীয় ঐক্য হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যকে বিএনপির শীর্ষ নেতারা নেতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। তারা মনে করেন, জাতীয় ঐক্য গঠনে বিএনপির প্রস্তাবে ক্ষমতাসীনরা সাড়া দেবে না। তাই প্রয়োজনে ক্ষমতাসীনদের রেখেই অন্য রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, পেশাজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রক্রিয়া বিএনপি এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিএনপি নেতারা মনে করেন, রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে দলমত নির্বিশেষে উগ্রবাদ দমন, দেশের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে একটি জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ঐক্যের আহ্বান ছিল সময়োপযোগী ও রাষ্ট্রনায়কোচিত। তার বক্তব্যে জনআকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে। দলমত নির্বিশেষে সবার আশা ছিল সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া আসবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। প্রধানমন্ত্রী যে ঐক্যের কথা বলেছেন তা মহাজোটেরও ঐক্য নয়। আর বিএনপিসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে শুধু ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে কিভাবে তিনি জাতীয় ঐক্য বলেন? বিএনপির এই নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে জাতি হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছে।

জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপি কি করবে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একটি জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু সরকার সেটাকে গুরুত্ব দেয়নি। আমরা উগ্র ও সন্ত্রাসবাদ দমনে এবং দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দলমত নির্বিশেষে একটি জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রক্রিয়া করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের দলের চেয়ারপার্সন দলের শীর্ষ ও জোটের শীর্ষ নেতাদের সাথে আলোচনা করেছেন। তিনি বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও পেশাজীবীদের সাথে কথা বলেছেন। অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও কথা বলবেন। এরপর জাতীয় ঐক্য কিভাবে গড়ে তোলা যায় তা নিয়ে রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে বিএনপি বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীসহ রাজনৈতিক নেতাদের সমন্বয়ে খুব শিগগির তিনটি কমিটি গঠন করবে। এসব কমিটি জাতীয় ঐক্য গঠনসহ জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস দমনে করণীয় নির্ধারণে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করবেন। এদিকে জামায়াত থাকলে জাতীয় ঐক্য হবে না, ঐক্য গড়তে হলে জামায়াতকে ছাড়তে হবে- এই ইস্যুতে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বিএনপি। দলটির একটি অংশ পরিস্থিতি আরো একটু পর্যবেক্ষণ করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চায়। উল্লেখ্য, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাসদ (রব), কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণফোরামসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে জাতীয় নির্বাচন আদায়ত ইস্যুতে বিএনপি একটি বৃহত্তর ঐক্য গঠনের আলোচনা চালালেও জামায়াত ২০ দলীয় জোটে থাকায় ওই দলগুলো ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। সম্প্রতি গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পরও বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবীরা জাতীয় ঐক্য গঠনে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে পরার্মশ দেন। বুদ্ধিজীবীরা জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নের দাবিও জানান।

বিএনপির একটি সূত্র জানায়, আপাতত বিএনপি জামায়াতকে ছাড়ছে না। এ জন্য আরেকটু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে দলটি। তবে জামায়াতকে ছাড়াই যদিও একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠার প্লাটফর্ম তৈরি হয় তাহলে বিএনপি জামায়াতকে বাইরে রেখেই জঙ্গিবাদ দমনে ঐক্য গঠনের দিকে এগিয়ে যাবে। বিএনপির কয়েক সিনিয়র নেতা জানান, জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে বিভিন্ন মহলের চাপ রয়েছে। এমনকি দলের অনেকেই চান না জামায়াত বিএনপির সঙ্গে থাকুক। বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতির কারণে এ বিষয়টি আবারো আলোচনায় চলে আসে। এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

Leave a comment