নেই রাস্তা-ঘাট খেলার মাঠ ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র
মহাসিন আলী: বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১১৬ নং মেল পিলার সংলগ্ন নবীননগর গ্রাম। ৪৭’র দেশ বিভাগের আগে গ্রামটি বাংলাদেশ (পূর্ব-পাকিস্তান) ও ভারতের যৌথ গ্রাম ছিলো। এ গ্রামের মোট ২৪০ ঘর বসতির ২০০ ঘর মানুষ বর্তমানে ভারতের অধিবাসী আর মাত্র ৪০ ঘর মানুষ নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও একই স্থানে বাংলাদেশের বাসিন্দা হয়ে বসবাস করছেন। তবে ওই গ্রামের ভারতের অংশে অবস্থিত পুরাতন মসজিদটিতে আজও গ্রামের বৃদ্ধরা নামাজ পড়েন। ভারতের মাটিতেই ওই গ্রামের ছেলেরা ফুটবল, ভলিবল, হা-ডু-ডুসহ নানা ধরনের খেলা করে থাকে।
গ্রামের ষাটোর্ধ্ব হিসাব আলী জানান, মেহেরপুর জেলা শহর থেকে নবীননগর গ্রামের দূরত্ব ৭ কি.মি.। মেহেরপুর সদর উপজেলার বুড়িপোতা ইউনিয়নের যেকোনো নিকটতম গ্রাম থেকে কমপক্ষে ৩ কি.মি. দূরে ভারত সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার এপারে নবীননগর গ্রামের অবস্থান। দেশ বিভাগের সময় নবীননগর গ্রামের খালপাড়ার অংশ পূর্বপাকিস্তানে আর নবীননগরের সিংহভাগ অংশ ভারতে পড়ে। তবে সে সময় কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় ভারতের নবীননগর অংশ ও পাকিস্তানের নবীননগর (খালপাড়া) অংশের বাসিন্দারা সুখে-দুঃখে পাশাপাশি থেকে বসবাস করেতেন। দেশ বিভাগের ৫০ বছর পরে ১৯৯৭ সালের অক্টোবর মাসে ভারত সরকার নবীননগর গ্রামের (ভারতের অংশের) ২০০ ঘর মানুষকে ভারতের আরো ভেতরে সরিয়ে নেয়। ২০০৩ সালে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের সময় নবীননগর গ্রামের ভারতের ওই অংশ কাঁটাতারের বেড়ার ভেতরে চলে যায়। বর্তমানের ৪০ ঘর লোক নবীননগর খালপাড়াতে বাস করছেন। ভারত সরকার তাদের অংশের মানুষগুলো এমনভাবে সরিয়ে নিয়েছে যার কারণে একই মায়ের গর্ভের ২ ছেলে হিসাব ও শহিদুল বাংলাদেশের নবীননগর খালপাড়াতে এবং কিতাব, সিতাব, আকবর, হাসিদুল ও ছাব্দার বসবাস করছেন ভারতের কাঁটাতারের ওপারের নবীননগরে বাস করছেন। একই কারণে আব্দুল হান্নান, আমানুল ও মিয়ারুল ৩ ভাই বর্তমানে বাংলাদেশের এবং জামানুল ও সদর ওরফে পাখি নামের ২ ভাই ভারতের বাসিন্দা। এছাড়া এমন আরো ২টি পরিবার আছে যাদের আপন ভাইদের কেউ বাংলাদেশ অংশে আবার কেউ ভারতের অংশে বাস করছেন। এদেশের বাসিন্দা নবীননগর খালপাড়ার মানুষ চাষাবাদ আর গরু-ছাগল পালন করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। সম্প্রতি কয়েক বছরে গ্রামের কয়েকজন যুবক কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে গেছেন। এখানের মানুষগুলো পরস্পর সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মধ্যে বাসবাস করেন।
বিএসএফ’র কাছে নিজেদের পরিচয়পত্র জমা দিয়ে কাঁটাতারের এপারের জমি চাষাবাদ করতে আসা ভারতীয় মানুষগুলো আজও খালপাড়াবাসীর খোঁজখবর নিয়ে আবার বিকেল পাঁচটার মধ্যে কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে ভারতে ফিরে যান। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া এক সময়ের ঘনিষ্ঠজন সুখ-দুঃখের সাথী মহিলাদের দু পারের বাসিন্দা করে রেখেছে।
কাঁটাতারের বেড়ার ওপারের নবীননগর গ্রামের বাসিন্দারা ভারতের নদীয়া জেলার তেহট্ট থানার নাটনা কোম্পানির নবীননগর সাব-কোম্পানি ক্যাম্পের বিএসএফ’র এবং নবীননগর খালপাড়াবাসী বাংলাদেশের মেহেরপুর সদর উপজেলার বুড়িপোতা কোম্পানি ক্যাম্প বিজিবির নজরদারিতে থাকেন। মাঝে-মধ্যে ভারত-বাংলাদেশের পুরাতন নবীননগরে বিজিবি-বিএসএফ পতাকা বৈঠক করেন।
ওই গ্রামের স্কুলশিক্ষক সিরাজুল ইসলাম জানালেন, নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে খালপাড়ার ৪০ ঘর মানুষ বাপ-দাদার ভিটে আকড়ে ধরে বসবাস করছেন। বর্তমানে গ্রামের লোক সংখ্যা প্রায় ২০০ জন। যার মধ্যে ভোটার সংখ্যা ১২০ জন। গ্রামটিতে নেই কোনো স্বাস্থ্য ক্লিনিক। খালপাড়া থেকে মেহেরপুর শহরে যেতে কমপক্ষে ৩ কি.মি. কাঁচারাস্তা পাড়ি দিয়ে বাড়িবাঁকা পর্যন্ত পৌঁছে পাকারাস্তায় উঠতে হয়। এরপর শ্যালোইঞ্জিনচালিত নসিমন, করিমন কিংবা আলগামনে করে মেহেরপুর পৌঁছুতে হয়। তবে ওই গ্রামবাসীর আসার অপেক্ষায় কোনো নসিমন, করিমন কিংবা আলগামন অপেক্ষায় থাকে না। বড় সমস্যা প্রতিবছর বর্ষায় রাতে কিংবা দিনে কোনো মানুষ অসুস্থ হলে তাকে খাটুলি করে খালপাড়া গ্রাম থেকে মেহেরপুর নিতে হয়।
গ্রামটিতে নেই কোনো খেলার মাঠ। সরেজমিনে খালপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায় কাঁটাতারের বাংলাদেশ পারে খালপাড়া গ্রামের শিশু-কিশোর ও তরুণরা ভারতের অংশে অবস্থিত খোলা জায়গায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভলিবল খেলছেন। কয়েকজন যুবক জানালেন, গ্রামে খেলার মাঠ না থাকায় তারা ফুটবল, ভলিবল, হা-ডু-ডু ও ক্রিকেট ভারতের এ অংশে খেলে থাকেন।
গ্রামের শত বছরের পুরাতন একমাত্র মসজিদটি কাঁটাতারের এপারের ভারতের অংশে অবস্থিত। খালপাড়ার নজরুল ইসলাম (৭৫) ও হিসাব আলীসহ (৫৬) গ্রামের কয়েকজন বৃদ্ধ এখনও মসজিদটিকে নিয়মিত আজান দেন, নামাজ পড়েন ও সন্ধ্যাবাতি জ্বালান। বর্তমানে বাংলাদেশের খালপাড়া অংশে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে গ্রামের সব বয়সের মানুষ নামাজ পড়েন।
স্কুলশিক্ষক সিরাজুল ইসলাম আরো জানান, ১৯৯২ সালে স্থাপিত নবীননগর কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বর্তমানে নবীননগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে মেহেরপুর সদর এলজিইডি’র বাস্তবায়নে ওই স্কুলটির একতলা স্কুলভবন নির্মাণ করা হয়েছে। বিদ্যালয়ে মোট ৫টি শিক্ষক পদের বিপরীতে একমাত্র শিক্ষক হিসেবে আছেন তিনি। সরকার ২০১৩ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে সরকারি ঘোষণা করলেও এ পর্যন্ত কিমিউনিটি শিক্ষক হিসেবে বেতন পান তিনি। ৩৩ শতক জমির ওপর অবস্থিত খালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে বর্তমান বছরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১৩ জন করে, তৃতীয় শ্রেণিতে ১২ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ৯ জন ও পঞ্চম শ্রেণিতে ৪ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তিনি আরো জানালেন, শিক্ষার্থী কম হলেও একজন শিক্ষকের পক্ষে প্রতিদিন ৫টি শ্রেণির কমপক্ষে ২ ডজন বিষয়ে পাঠদান সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের কেউ প্রাথমিক সমাপনী শেষ করলেও মাধ্যমিকের জন্য কমপক্ষে সাড়ে ৩ কি.মি. কাঁচারাস্তা পাড়ি দিয়ে নিকটবর্তী শালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতে হয়। যা মেয়েদের জন্য এক প্রকার দুঃসাধ্য কাজ।
বুড়িপোতা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ মুকুল জানান, নানা প্রতিকূল অবস্থার কারণে আমি বহুবার চেষ্টা করেছি নবীননগর খালপাড়ার মানুষগুলোকে বুড়িপোতা ইউনিয়নের বাড়িবাঁকাসহ অন্য কোনো গ্রামে সরিয়ে নিতে। কিন্তু তাদের থেকে কোনো সাড়া পাইনি। তিনি আরো বলেন, বাড়িবাঁকা থেকে নবীননগর (খালপাড়া) পর্যন্ত ৩ কি.মি. রাস্তা পাকা করা ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমরা গ্রামের মধ্যের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকশত ফুট রাস্তা হেরিং করে দিয়েছি।
মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৪ সালের ৩০ মে আমি ওই গ্রামে বিদ্যুত উদ্বোধন করেছি। এ মুহূর্তে বিনোদন ও খবর শোনার জন্য ডিশলাইন সংযোগ দিয়েছে বেসরকারি সংগঠন ডিশকেবল অপারেটর এনএসএফ। ১৯৯৯ সালে ওই গ্রামের ৪৫০ ফুট ও ২০১৪ সালে ১২০ ফুট রাস্তা পাকা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে তাদের সুবিধার্থে ৩ কি.মি. রাস্তা পাকাকরণসহ গ্রামের অন্য উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হবে।