স্টাফ রিপোর্টার: গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার পর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সবার মুখে আলোচিত হচ্ছে। সেটি হচ্ছে ‘নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি’। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখন পর্যন্ত তিনটি জঙ্গি হামলার সাথে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা এই ইউনিভার্সিটি নিয়ে তদন্তে নেমেছে। এখানে পড়তে আসা উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানদের সুকৌশলে উগ্র মৌলবাদী কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য ‘মগজ ধোলাই’ করা হয়। বিপুল বিত্তের মধ্যে জন্ম গ্রহণকারী এসব সন্তান ডুবে যায় ধর্মের নামে অন্ধকার জগতে। সেই উগ্র মৌলবাদী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে এক পর্যায়ে বাবার রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পাড়ি জমায় অজানার উদ্দেশে। সেখানে আরো ১০-১৫ জন একত্র হয়ে ইসলামের নামে সাধারণ মানুষ হত্যার পরিকল্পনা করে। ৬-৭ মাস ধরে এসব প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা নেমে পড়ে অপারেশনে। চাপাতি, পিস্তল আর গ্রেনেড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর। ‘ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করলে বেহেস্ত পাওয়া যাবে’ এমন ধারণা থেকে তারা এই জগতে পা বাড়াচ্ছে।
২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের ব্লগার ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যার ঘটনায় নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক এবং ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস বিভাগের বহিষ্কৃত ৫ ছাত্র সাদমান ইয়াছির মাহমুদ, ফয়সাল বিন নাঈম দীপ, এহসান রেজা রুম্মান, মাকসুদুল হাসান অনিক, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজ গ্রেফতার হন। ওই ঘটনার আগেই নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরকে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ আনা হয় কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে। তদন্তে প্রমাণ পাওয়ায় ৪ শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপরও নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিতে উচ্চবিত্ত ঘরের যেসব সন্তান লেখা পড়া করতে যায় জঙ্গি কার্যক্রমের সাথে তাদের বিরুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে। নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির অন্তত অর্ধশত শিক্ষার্থী এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। এদের অভিভাবকরা সন্দেহ করছেন, এরা নিখোঁজ হয়ে জঙ্গি কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে পড়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে শিক্ষার্থীরা জঙ্গি কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। ইসলামী উগ্র মৌলবাদী তৈরিতে সেখানে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে সমাজের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এর সাথে ইউনিভার্সিটির কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকরা জড়িত রয়েছেন। কারণ এর আগেও তাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনা হলে তারা এড়িয়ে গেছেন। তিনি আরো বলেন, জননিরাপত্তার বিষয়ে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের দায় রয়েছে। নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিকে সেই দায় নিতে হবে। এজন্য তাদেরকে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। তাদের শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
১৯৯২ সালে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ পর্যন্ত আনুমানিক ৬০ হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণ করে বেরিয়ে গেছেন। এদের মধ্যে বিবিএ ফ্যাকাল্টি ও ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। এই দুই ফ্যাকাল্টির শিক্ষকদের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবির ও হিযবুত তাহরীরকে পৃষ্ঠপোষকতা করারও অভিযোগ রয়েছে।
নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য বেনজীর আহমেদ বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা আগের চেয়ে এখন বেশি সচেতন। এ বিষয়ে আমরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। মসজিদ থেকে জঙ্গি কার্যক্রমের প্রচারণা চালানোর ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, মসজিদ আমাদের ক্যাম্পাসের বাইরে। সেখানে বসে কিছু করা হলে, আমাদের করণীয় কিছু থাকবে না।
নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের হাতে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন নিহত হওয়ার পর বিজ্ঞান মনস্ক লেখক অভিজিত রায় তার ব্লগে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিকে নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী লেখা লেখেন। সেখানে তিনি বলেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের আস্তানায় পরিণত হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। এই ইউনিভার্সিটিতে হিযবুত তাহরীরের পাশাপাশি শিবিরের পূর্ণাঙ্গ সক্রিয় কমিটি রয়েছে। বাইরে থেকে ‘আধুনিক’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেজ তৈরি হলেও দিনের পর দিন জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত ট্রাস্টি বোর্ডের দুই সদস্য ও ৫ শিক্ষকের প্রত্যক্ষ মদদে উগ্র মৌলবাদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ১৯৯২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে হিযবুত তাহরীরের বীজ ঢুকিয়ে দেয়া হয়। তখনকার যারা উদ্যোক্তা ও শিক্ষক ছিলেন তাদের মধ্যে জামায়াতের মতাদর্শের ছিলেন শায়েস্তা আহমেদ, নূরুল এইচ খান, মাহবুব হোসেন ও শাহ আব্দুল হান্নান। হিযবুত মতাদর্শের ছিলেন ড. মঞ্জুরুল হক, ড. আব্দুল হান্নান চৌধুরী, ড. গোলাম মোহাম্মদ ও শেখ তৌফিক। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির চার জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে হিযবুত তাহরীরকে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা অভিযোগ করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
ৱ্যাব ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির নামাজ ঘর থেকেই হিযবুত তাহরীর প্রচারণা চালানো হয়। দুপুরে জোহরের নামাজের পর ‘পাঠসভা’র নামে হিযবুতের প্রচারণা চালানো হয়। সেখানে ইউনিভার্সিটির কয়েকজন শিক্ষকও পর্যায়ক্রমে বক্তৃতা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যেসব শিক্ষার্থী ধর্মীয় দিক থেকে অনেকটা নমনীয় তাদেরকেই টার্গেট করা হয়। এরা পাঠসভায় অংশ নেয়ার পর ধীরে ধীরে জঙ্গি কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে পড়ে।