চারদিকে আতঙ্ক নিরাপত্তাহীনতা

 

স্টাফ রিপোর্টার: ধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসী হামলার রক্তের দাগ না শুকাতেই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের আধা কিলোমিটারের মধ্যে আরেকটি বর্বর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। গত বৃহস্পতিবার ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের জন্য যখন দেশের সর্ববৃহৎ এই ঈদগাহের দিকে মানুষের স্রোত ঠিক তখনই সন্ত্রাসীরা দায়িত্বরত পুলিশের ওপর বোমা হামলা চালায়। এতে দুই পুলিশসহ চারজন নিহত হন। আহত হয়েছেন প্রায় ১২ জন। যাদের অধিকাংশই পুলিশ।

কিশোরগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার ওবায়দুল হাসান জানান, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শোলাকিয়া মাঠের আড়াইশ মিটারের মধ্যে আজিমুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ফটকের কাছে নিরাপত্তার দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের ওপর এই হামলার ঘটনা ঘটে। এর আগে গত পহেলা জুলাই রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসী হামলায় ১৭ বিদেশি নাগরিক, পুলিশের ২ কর্মকর্তা ও ৬ সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীসহ ২৮ জন নিহত হন। এ ঘটনায় বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ ও নিরাপত্তা নিয়ে যখন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ঠিক এরই মধ্যে আরেকটি সন্ত্রাসী ঘটনা দেশের মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। নিরাপত্তাহীনতায় ফেলেছে সাধারণ মানুষকে।
শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাটি মিডিয়ার কল্যাণে তাৎক্ষণিক দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পরে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গুলশান ট্র্যাজেডির পর শোলাকিয়ায় বৃহস্পতিবারের সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে তারা সবাই উদ্বিগ্ন ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তারা বলছেন, যেখানে প্রকাশ্যে পুলিশ সদস্যদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে সেখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়।

কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদ জামাতে সন্ত্রাসী হামলার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশে ভ্রমণের ওপরে সতর্কতা জারি (ট্রাভেল অ্যালার্ট) করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। বৃহস্পতিবার দুপুরে দেশটির পররাষ্ট্র দফতরের ওয়েবসাইটে এক জরুরি বার্তার মাধ্যমে এ ভ্রমণ সতর্কতা জারি করা হয়। নোটিশে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের বাংলাদেশ সফরের ঝুঁকি সতর্কতার সাথে বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে। বার্তায় বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র সরকার মনে করে সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি সত্য ও বিশ্বাসযোগ্য। তাই সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার পরে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা যেন সতর্কতার সাথে বাংলাদেশ সফরের ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনা করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর এক শিক্ষক ও এক অনলাইন মিডিয়ার কর্মী বলেন, সাধারণ মানুষ এখন উভয় সঙ্কটে রয়েছে। একদিকে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা অন্যদিকে সন্ত্রাসী হামলার পরে সন্দেহজনকভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক হয়রানি হতে হয় কি-না এ নিয়েও ভয়ে থাকতে হচ্ছে।

এ ব্যাপারে সিপিবির পলিট ব্যুরোর সদস্য হায়দার আকবর খান রনো বলেন, ‘ঘটনাটি খুবই সিরিয়াস। আমরা অস্বম্ভব রকম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। এ নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করলে হবে না। আমার মনে হয়, সবাই মিলে জনগণকে এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নামাতে হবে। পাশাপাশি প্রশাসনিক পদক্ষেপ ও গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে।’ তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সম্প্রতি এক লাখ আলেমের যে বিবৃতি দেয়া হয়েছে এটা খুবই ভাল কাজ। কিন্তু এটা যথেষ্ট না। সরকারের উচিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মানুষকে মাঠে নামানো এবং জনগণকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমিসহ সাধারণ মানুষ এ দুটি ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি। আমি এবং আমার মতো অনেকেই গুলশানের ঘটনায় মনে করেছিলাম আমাদের রাজনীতিবিদরা অনুধাবন করবেন যে, জাতিগতভাবে সম্মিলিতভাবে এই অপশক্তির মোকাবেলা করতে হবে। আমরা মনে করেছিলাম তারা একে অপরকে নিয়ে জনগণকে সংঘবদ্ধ করে অপশক্তিকে কীভাবে প্রতিহত করা যায় এ ব্যাপারে এগিয়ে আসবে। কিন্তু যেটা দেখছি তা হওয়া দুরূহ। তবুও আমরা এ বাপারে আশাবাদী তাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে এবং ১৬ কোটি মানুষের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তারা দায়িত্বশীল আচারণ করবে। প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসন দুই জনই সন্ত্রাস মোকাবেলায় জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন। তাদের এ কথার বাস্তবায়ন দেখছেন কিনা জানতে চাইলে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, শুধু ঐক্যের কথা বললে তো হবে না। মানসিকতার পরিবর্তন যদি না হয়, আপনি যদি আসলেই এটি (ঐক্য) করতে না চান তাহলে তো হবে না। তাদের এটি বুঝতে হবে। তাদের (শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়া) বুঝা উচিত ছিল ২০০৬-০৮ সালেই। বুঝে নাই। এখনো যদি তারা না বুঝে তাহলে আমরা আরো মাসুল দেব।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়া লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার তার সরকারি বাসভবন গণভবনে সর্বস্তরের জনগণের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় ও সংবাদমাধ্যমের সাথে আলাপে বলেছেন, আমরা পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের স্থান হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইসলাম কোনো নিরীহ মানুষকে হত্যা বরদাস্ত করে না- এমনকি অন্য ধর্মের অনুসারীদেরও। একমাত্র আল্লাহই চূড়ান্ত ন্যায়বিচারক এবং তিনি কখনো অন্য কারো হাতে দায়দায়িত্ব প্রদান করেননি। অন্যদিকে ঈদের দিন দুপুরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠান শেষে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের বলেন, জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ব্যর্থ হয়েছে। কিশোরগঞ্জে শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতের কাছে বিস্ফোরণ এবং গুলির ঘটনায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আজকে শোলাকিয়ায় যে ঘটনা ঘটেছে এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা গভীরভাবে মর্মাহত। গুলশানের ক্যাফেতে জঙ্গি হামলায় ১৭ বিদেশিসহ ২০ জন নাগরিক হত্যার প্রসঙ্গ তুলে খালেদা জিয়া আরও বলেন, ‘আজকে দেশের অবস্থা মোটেই ভালো নয়, অত্যন্ত খারাপ। প্রতিটি মানুষ আজকে ভয়ের মধ্যে, আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।

উগ্রবাদ মোকাবিলায় আবারও জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে খালেদা জিয়া বলেন, এখন প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। সকলে মিলে দেশের ওপর যে একের পর এক নৃশংস ঘটনা ঘটছে তা বন্ধ করা দরকার। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, যারা জোর করে ক্ষমতায় আছে তারা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নয়, তারা (সরকার) দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা ও সান্ত্বনা দেয়ার বদলে যা ইচ্ছে কথাবার্তা বলছে। তারা শুধু ইচ্ছা মতো বেস্নইম দেয়। এখন বেস্নইম-গেইম চলছে। সত্যিকারের অপরাধীদের না ধরার অভিযোগ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, বরং বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরা হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের এমনভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে যে প্রকৃত অপরাধীরা অপরাধ করেই চলেছে, তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতের মাঠের কাছে বোমা হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, পবিত্র ঈদের দিন যারা এসব সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে পারে তারা ইসলামের শত্রু। ইসলামের এইসব অজ্ঞাত শত্রুদের চিহ্নিত করে নির্মূল করতে হবে। এইসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এদিকে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহে টহলরত পুলিশ ও নিরীহ মানুষের ওপর সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির প্রিন্সিপাল মওলানা হাবীবুর রহমান ও মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক। এক বিবৃতিতে তারা বলেন, মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ জামাতের প্রস্তুতিকালে টহলরত পুলিশ ও নিরীহ মানুষের ওপর হামলা করেছে। তারা ইসলাম, মুসলমান ও দেশ-জাতির শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে সকল পেশা ও মতের লোক এবং আলেম-উলামাদের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখতে হবে।

অপর এক বিবৃতিতে চরমোনাই পীর ও ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, ঈদের জামাতে আসা মুসল্লিদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা কোনো সুস্থ বিবেকবান মানুষ মেনে নিতে পারে না। এ হামলা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তেরই অংশ। এ ধরনের হামলা ইসলাম কখনও সমর্থন করে না। তিনি হামলাকারী যুবকদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা যে পথে চলছ সেটা ইসলামের পথ নয়। তোমাদের কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে বিপথে পরিচালিত করছে। ইসলামের পথে যদি চলতে চাও তবে ওলামায়েকেরামের পরামর্শ মেনে চলো। এসব মানবতাবিরোধী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সবাইকে সজাগ থাকারও আহ্বান জানান তিনি।

ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, এসব সন্ত্রাসীর সাথে মুসলিম উম্মাহর কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। এ ধরনের সন্ত্রাসীদের ধর্মের কথা বলে মনে হয় কাজ হবে না। তাদের বিরুদ্ধে সরকারের প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত। মসজিদের খতিব-ইমাম, স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষকদের এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নামানো উচিত। এক্ষেত্রে দল-মত নির্বিশেষে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত বলে আমি মনে করি। শোলাকিয়ার ঘটনায় পুলিশ কনস্টেবল জহুরুল হক (৩০) ও আনছারুল (৩৫) নিহত হয়েছেন। সন্ত্রাসীদের সাথে পুলিশের গোলাগুলির সময় নিজের বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন গৃহবধূ ঝর্ণা রানী ভৌমিক। আর পুলিশের গুলিতে অজ্ঞাত পরিচয় এক হামলাকারী নিহত হয়েছে আর আটক হয়েছে তিনজন।

Leave a comment