মাথাভাঙ্গা মনিটর: ধর্ম প্রচারের নামে জঙ্গীবাদী কর্মকাণ্ডে উসকানি দেয়ার অভিযোগে বিতর্কিত বক্তা জাকির নায়েকের পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করেছে ভারত। সম্প্রচার বন্ধ করতে এরই মধ্যে কেবল অপারেটরদের নির্দেশ দিয়েছে দেশটির তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। জাকির নায়েককে গ্রেফতারেরও দাবি তুলেছেন দেশটির মুসলিম নেতারা। এদিকে জাকির নায়েকের বিকৃত কথায় তরুণরা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশেও পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধের ইঙ্গিত দিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। আজই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানা গেছে। এদিকে সরকার নির্দেশ দিলেই সম্প্রচার বন্ধ করবেন বলে জানিয়েছেন কেবল অপারেটররা।
ভারতের মহারাষ্ট্রে জন্ম নেয়া জাকির আবদুল করিম নায়েক চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রিধারী। ৪৭ বছর বয়সী এই ব্যক্তি ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট। পিস টিভি ওই ফাউন্ডেশনেরই প্রতিষ্ঠান। ভারতের সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত তার ভাষণে দেখা যায় তিনি বলছেন, প্রত্যেক মুসলিমেরই সন্ত্রাসবাদী হওয়া উচিত। বর্তমানে দুবাইয়ে রয়েছেন জাকির নায়েক। কয়েক দিনের মধ্যে তিনি ভারতে ফিরতে পারেন। জাকির নায়েকের কার্যক্রম ইসলাম ও ভারতীয় সংস্কৃতির বিরোধী হওয়ায় ২০০৮ সালে লক্ষ্ণৌ, কানপুর ও এলাহাবাদের রাজ্যসরকার তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে জাকির নায়েকের ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন যুক্তরাজ্য ও কানাডায় নিষিদ্ধ। এমনকি মুসলিম প্রধান মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াতেও জাকির নায়েকের বক্তব্য প্রচার নিষিব্ধ। তবে এতোদিন কেবল অপরারেটররা বিশেষ কৌশলে ভারতে পিসি টিভির সম্প্রচার চালিয়েছিলো। যার সম্প্রচার কার্যক্রম চলে মূলত দুবাই থেকে। তবে ভারতের মুম্বাই শহরে আছে অফিস। জানা গেছে, বাংলাদেশে কেবল টিভির কার্যক্রম চালাতেই সীমাবদ্ধ নন জাকির নায়েক। তার সমর্থন নিয়ে পিস স্কুল নাম দিয়ে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনাও করছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দল জামায়াত-শিবির। যেখানে শিক্ষার আড়ালে জামায়াতের জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড চলছে বলে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তেও বেরিয়ে এসেছে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে তাগাদা দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ নেই। অমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করতে গিয়ে দলটির এক সভায় বলেছিলেন, তার (ডা. জাকির নায়েক) কথা মনে পড়লে মন থেকে শুধু দোয়াই আসে। ডা. জাকির নায়েক একটি নাম, একটি বিস্ময়। সিনেমার না বাস্তবের হিরো। মা-শা-আল্লাহ! সমকালীন বিশ্বে মুসলিম উম্মার অহঙ্কার তিনি। যেখানেই যাচ্ছেন ডা. জাকির, অমুসলিমদের সামনে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরছেন। শনিবার ভারতে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ ও বাংলাদেশে বন্ধের তোরজোরের প্রেক্ষাপটে এখন বিচলিত জামায়াত-শিবির। শনিবার সকাল থেকেই জামায়াত-শিবিরের ফেসবুক পেজ বাঁশের কেল্লাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে চলছে ভারতবিরোধী প্রচারণা।
বাংলাদেশের গুলশানে রেস্তরাঁয় হামলার পর ভারতে বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে শনিবার সকালেই পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করতে কেবল অপারেটরদের নির্দেশ দিয়েছে দেশটির তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। সেই সাথে আরও যেসব অনুমোদনবিহীন টেলিভিশন সম্প্রচারে আছে, সেগুলোও বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যথায় শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। যদিও এর আগে একবার ভারতে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিলো সরকার। তারপরও কিছু কেবল অপারেটর এটি বিশেষ ব্যবস্থায় সম্প্রচার করে আসছিলো। সম্প্রতি বাংলাদেশে গুলশানে একটি রেস্তরাঁয় হামলার পর ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা জাকির নায়েকের মালিকানাধীন পিস টিভি ও জাকির নায়েকের ভূমিকা নিয়ে আবারও বিতর্ক ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। বিশেষ করে, গুলশানে হামলাকারীদের দুজনের ফেসবুক থেকে জানা যায় যে তারা জাকির নায়েকের বক্তব্যে জঙ্গি হামলায় উদ্বুদ্ধ হন। এটি জানার পরই জাকির নায়েকের জনসমক্ষে দেয়া বক্তব্য তদন্ত করতে পুলিশকে নির্দেশ দেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী।
সর্বশেষ ভারতের উত্তর প্রদেশের মুসলিম নেতারা জাকির নায়েককে ইসলামবিরোধী ও ভারতবিরোধী আখ্যা দিয়ে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ এবং তাকে গ্রেফতারের দাবি জানান। গত কয়েক দিন ধরেই মুম্বাইয়ে অবস্থিত জাকির নায়েকের ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন কার্যালয়ের চারপাশে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ঘিরে রেখেছেন। এর মধ্যেই পিস টিভি সম্প্রচার বন্ধের নির্দেশ দেয় সরকার। এর দু দিন আগেই অবশ্য ভারতের অবস্থানের কথা জানিয়েছিলেন দেশটির স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজ্জু। তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাদেশের অনুরোধ পেলে জাকির নায়েকের প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ করার কথা ভাবতে পারে তারা। তিনি বলেন, ভারতে একটি আইন রয়েছে, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করা যায়। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে আমরা নিষিদ্ধ করতে পারি ওই আইনে। ওই আইনে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এ পর্যন্ত নেয়া হয় না। তবে যেহেতু বাংলাদেশের নিরাপত্তার বিষয়টিকে ভারত সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে, সেহেতু ভারত ব্যক্তির বিরুদ্ধেও ওই আইন ব্যবহারের কথা ভাবতে পারে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। বলেন, আমরা যদি ঢাকা থেকে অনুরোধ পাই, তাহলে জাকির নায়েককে নিষিদ্ধের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করব।
এদিকে জানা গেছে, কেবল ঢাকার জঙ্গিরাই নয়, জাকির নায়েকের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আইএসে যোগ দিতে গিয়েছিলো সিরিয়া ফেরত মুম্বাইয়ের আরিব মজিদও। ভারতীয় গোয়েন্দাদের জেরায় নিজেকে জাকিরের ভক্ত বলে জানিয়েছে এককালে আইএসের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আরিব। জাকির নায়েকের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে জিহাদের প্রতি তার মনোনীবেশ আরও বাড়ে বলে জানিয়েছে সে। ইরাক ও সিরিয়ায় দীর্ঘদিন আইএস থেকে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে নিজের বাড়িতে ফেরে আরিব। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে গ্রেফতার করে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ। বিহারের একটি গ্রন্থাগার থেকেও সম্প্রতি জাকিরের ভাষণের অনেক সিডি মিলেছে। ওই গ্রন্থাগারটিতে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের যাতায়াত রয়েছে বলে বলছে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো। জঙ্গীবিরোধী প্রচারণার নামে তহবিল সংগ্রহ করে পিস টিভিতে ঢেলেছেন জাকির নায়েক!
২০০৭ সালের ২৪ জানুয়ারি ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান খোলা হয় যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। অন্য কাজের পাশাপাশি এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিলো ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সম্মেলন বাড়ানো, সন্ত্রাসবাদের শিকার তরুণদের মাদক থেকে রক্ষা করার মতো বিষয়গুলো। ড. জাকির নায়েক এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। সংগঠনটি একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত। ২০০৭ সালে এর নিবন্ধন হয়। তখন জাকির নায়েক ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে বলছে, জাকির নায়েক ওই দাতব্য প্রতিষ্ঠানের নামে টাকা নিয়ে তা অপপ্রচারমূলক প্রতিষ্ঠান পিস টিভিতে বিনিয়োগ করেছেন। এ সংক্রান্ত বহু তথ্যপ্রমাণ হাতে পাওয়ার কথা জানিয়েছে তারা। ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাকির নায়েক মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা নিয়েছেন ওই প্রতিষ্ঠানের নামে। ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন ইন্টারন্যাশনাল-এর অফিসটি এখন লন্ডনের ইডব্যাস্টন থেকে পরিচালিত হয়।
ইন্ডিয়া টুডে তাদের হাতে থাকা নথির বরাত দিয়ে বলছে, ২০১৫-২০১৬ সালে ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন ইন্টারন্যাশনাল ৯ লাখ ৭২ হাজার ৪৯০ ব্রিটিশ পাউন্ড অর্থ সহায়তা পায়। ওই অর্থবছরে তারা দাতব্য কাজে ব্যয় করে ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৪৯০ পাউন্ড। তবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দাতব্য কাজে ব্যয়কৃত ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৪৯০ পাউন্ড অর্থের মধ্যে ৭ লাখ ৭১ হাজার ২১৮ পাউন্ডই ব্যয় করা হয়েছে পিস টিভির নামে। সেই হিসেবে বার্ষিক আয়ের ৭৯ শতাংশ তহবিলই পিস টিভিতে ঢালা হয়েছে। আর ২০১৪-২০১৫ সালে ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন ইন্টারন্যাশনাল নামে তোলা দাতব্য ফান্ডের ৯১ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে পিস টিভির পেছনে। ইন্ডিয়া টুডের তথ্য অনুযায়ী, ৭ বছরে ৯ মিলিয়ন পাউন্ডকে ভারতীয় মুদ্রায় রূপান্তর করে ৭৮০ মিলিয়ন ভারতীয় রূপি পিস টিভিতে ঢেলেছেন জাকির নায়েক।
জাকির নায়েককে গ্রেফতার দাবি ভারতের মুসলিম নেতাদের: জাকির নায়েকের কার্যক্রম ইসলাম ও ভারতীয় সংস্কৃতির বিরোধী অভিযোগ তুলে তাকে গ্রেফতারের জোর দাবি জানিয়েছেন ভারতের উত্তর প্রদেশের মুসলিম নেতারা। গত দু দিন বিভিন্ন ঈদগাহে দেয়া বক্তৃতায় তারা সন্ত্রাসবাদে উসকানি দেয়ার অভিযোগে জাকির নায়েক ও তার পিস টিভি নিষিদ্ধের দাবি জানান।
তারা অভিযোগ করেছেন, ইসলামের যে ব্যাখ্যা তিনি সেসব বক্তৃতায় দেন, তা নিয়ে ঠিক নয়। তার বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বহু তরুণ জঙ্গিবাদে ঝুঁকছে। উত্তর প্রদেশের বারেলি অঞ্চলের ইমাম মওলানা শাহাবুদ্দিন রেজভি বলেন, ঢাকার ক্যাফেতে হামলাকারীরা জাকির নায়েকের অনুসারী ছিলো। তার বক্তব্য সন্ত্রাসীদের সহযোগিতা করছে, মুসলমানদের উগ্র হতে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে।