নীতিনির্ধারকরা শঙ্কিত : জঙ্গি ইস্যুতে বেকায়দায় সরকার

 

স্টাফ রিপোর্টার: দেশে আইএস কিংবা আল-কায়দার মতো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব নেই বলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা জোরালো দাবি তুললেও এ ইস্যুতে ক্ষমতাসীনরা এখন চরম বেকায়দায়। বিশেষ করে একদলীয় রাজনীতির উত্থান, মানবাধিকার পরিস্থিতি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বস্নগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, সমকামী অধিকারকর্মী, ধর্মগুরু ও শিক্ষক হত্যাকা- নিয়ে সরকারের ব্যাখ্যায় সম্প্রতি যুক্তরাজ্যসহ প্রভাবশালী বিভিন্ন রাষ্ট্র দ্বিমত পোষণ করায় এ উৎকণ্ঠায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। স্রেফ জঙ্গিবাদের ধোঁয়া তুলে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করতে পারে এ শঙ্কা এখন সবার মধ্যে জেঁকে বসেছে। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকদের আশঙ্কা, আইনশৃঙ্খলা, মানবাধিকার ও অর্থনীতিসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও দেশি-বিদেশি জঙ্গিদের নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে সরকার। কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করেও এ উদ্বেগজনক সঙ্কট সামাল দেয়া যাবে কি-না তা নিয়েও তারা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছে। তাই এ পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন সরকার এখন বিকল্প উপায়ে এ সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজছে। সরকার ও আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

তবে অপরাধ বিশ্লেষকদের ধারণা, বিরোধী দলকে দমনে আওয়ামী লীগ সরকার অনেকটা সেধে জঙ্গিবাদের যে ফাঁস গলায় পরেছে তা সহজে খুলে ফেলা সত্যিকারে অর্থেই কঠিন হবে। বরং এ ইস্যুতে পানি ঘোলা করতে গেলে সরকারকে বড় ধরনের খেসারত দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।এদিকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আওয়ামী লীগ জঙ্গিবাদের ইস্যুতে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে। হত্যাযজ্ঞসহ বড় ধরনের কোনো নাশকতার ঘটনা ঘটলেই সরকার তথা প্রশাসন নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে তা বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর ঘাড়ে চাপিয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় পুলিশও ছিঁচকে সন্ত্রাসীদের ধরে তাদের আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর নেতাকর্মী আখ্যা দিয়ে নিজেদের কৃতিত্ব জাহিরের চেষ্টা করেছে। এ সময় সরকার এর প্রতিবাদ না করে পরোক্ষভাবে তা মেনে নিয়েছে।

অন্যদিকে ব্রিটেনের জিহাদিরা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশে (বাংলাদেশ) জঙ্গিবাদকে উসকে দিচ্ছে এমন উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ানকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। তিনি এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের প্রতি আহ্বান জানান।

ব্রিটিশ জিহাদিরা বাংলাদেশে ইসলামী আদর্শ পুনরুত্থানে ইন্ধন জোগাচ্ছে এবং আইএস জঙ্গিদের প্রতি সহানুভূতিশীল একটি প্রজন্মকে তারা এ আদর্শে দীক্ষা দিচ্ছে বলেও বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বিভাগের বিশেষজ্ঞরা অভিমত দেন। যা ওই সময়ে দৈনিক গার্ডিয়ানে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, ক্ষমতাসীন সরকার যে টার্গেট নিয়েই দেশে জঙ্গিবাদ সক্রিয় হয়ে ওঠার খবর চাউর করুক না কেন তা এখন তাদের জন্যই  ‘বুমেরাং’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠী হয়তো সে সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। তবে একে ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’ বলার কোনো পথ বাংলাদেশ সরকারের সামনে খোলা নেই বলে মন্তব্য করেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি ও বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া বলেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। তা না হলে উগ্রপন্থীদের হাতে হত্যাকা-গুলো সংঘটিত হওয়ার পর এর কারণ খুব সহজেই উদ্ঘাটন হয়ে যেত। কিছুদিন আগেও সরকার সব ধরনের হত্যাকে জঙ্গিদের কাজ বলে চালিয়ে দিত। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা (সরকার) ওইসব হত্যা রহস্যের জট খুলতে পারেনি। এতেই বোঝা যায়, দেশ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের শিকার।
প্রবীণ এই অধ্যাপক বলেন, মন্দির, গির্জায় হামলার ঘটনার পর এবার দেশে ধর্মের নামে মানুষ হত্যাও শুরু হয়েছে। কিন্তু সরকারের গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনেক ক্ষেত্রেই এসব হত্যার সূত্র খুঁজে পাচ্ছে না। তাই বিষয়টা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল প্রশ্ন তুলবে- এটাই স্বাভাবিক। জাতিসংঘ, ইইউসহ বিভিন্ন সংস্থা এখন সে কথাই বলছে।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সদস্য ও পরিসংখ্যান, প্রাণপরিসংখ্যান ও তথ্য পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান মনে করেন, বাংলাদেশ ‘বাংলাভাই’ কিংবা ‘জেএমবি’র মতো উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী সংগঠনের কবলে পড়েছে। এখানে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বিষয়টা অবাঞ্ছিত। তিনি বলেন, দেশে অতীতে অনেক বড় বড় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু তখন আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রসঙ্গ আসেনি। বর্তমানেও সেই আশঙ্কা নেই বলে তিনি মত দেন।  ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের ওপর অবরোধ আরোপের প্রশ্ন প্রসঙ্গে অধ্যাপক লুৎফর বলেন, শুধু ব্রিটেন কেন, যেকোনো দেশই অন্য দেশের ওপর অবরোধ আরোপবিষয়ক প্রশ্ন তুলতে পারে। কিন্তু তা হওয়া অনেকটাই অসম্ভব। কারণ, বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। স্বাধীন, সার্বভৌম দেশে চাইলেই যে কেউ অবরোধ আরোপ করতে পারে না। এদিকে সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক মহল বিশেষ করে আমেরিকা জঙ্গিবাদের কথা বলে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে সরকারের পতন ঘটাতে চাইছে। আর এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে জামায়াত-বিএনপিকে আশ্রয় দিয়ে দেশীয় জঙ্গিদের সক্রিয় হয়ে ওঠার পথ সুগম করে দিয়েছে। যার ধারাবাহিকতায় একের পর এক বস্নগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মগুরু, ভিন্ন মতানুসারী ও বিদেশি খুন হয়েছে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এ অপতৎপরতার অগ্রভাগে থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আন্তর্জাতিক এ ষড়যন্ত্রের সুযোগ নিয়েছে বলেও দাবি করেন তারা।

তবে দেশের বিশেষজ্ঞ মহলের ভাষ্য, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট আইএসের শাখা বাংলাদেশে আছে কি নেই, তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ এখন আর নেই। কারণ আইএস না থাকলেও প্রায় একই আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে স্থানীয় জঙ্গি সংগঠনগুলো তৎপর হয়ে উঠেছে। একের পর এক শিক্ষক, লেখক, প্রকাশক, বস্নগার, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হত্যার ঘটনা এরই প্রমাণ দিচ্ছে। একই সাথে জঙ্গি দমনে সরকারের ব্যর্থতাও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তাই এ পরিস্থিতি মোকাবেলাই এখন সরকারের সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া জরুরি। দেশে জঙ্গি তৎপরতা পুরোপুরি বন্ধ করা গেলে কথিত ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’ মুখ থুবড়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেন সুধীজন প্রতিনিধিরা।
পুলিশের এআইজি পদমর্যদার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেশে জঙ্গিবাদ চাঙা হয়ে ওঠার বিষয়টি পুরোপুরি রাজনৈতিক। তাই এ সঙ্কট নিরসনে রাজনীতিকদেরই আগে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে তা নিয়ন্ত্রণ করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

ওই পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্য, গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে বা অপব্যবহার করে অস্বাভাবিক পদ্ধতিতে সরকার গঠন ও পরিচালনা করা হলে সরকারের জবাবদিহিতার অভাব থাকে, সুশাসন ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ থাকে না। ফলে ক্ষোভ, অসন্তোষ, হতাশা সৃষ্টি হয় ও তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের বা সরকার পরিবর্তনের সুযোগ না থাকলে হতাশা সাধারণত বিদ্বেষ, হিংসা, জিঘাংসায় রূপান্তরিত হয় ও মানুষকে সন্ত্রাসবাদের দিকে ঠেলে দেয়। ফলে এ ধরনের সরকার যতই দীর্ঘস্থায়ী হয় ততই সামাজিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে। রাজনীতির স্থিতিশীলতা ভঙ্গুর থেকে আরো বেশি ভঙ্গুর হতে থাকে এবং রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

পুলিশ সদর দফতরের কর্মরত শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা জানান, দেশে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও উগ্রপন্থী মৌলবাদীদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠাসহ বেশ কয়েকটি ইস্যুকে সমান গুরুত্ব দিয়ে এরই মধ্যে তারা কাজ শুরু করেছে। এর সাথে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততা আছে কিনা তা-ও খুঁজে দেখা হচ্ছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

Leave a comment