এবার নিয়ে গত এক মাসে সুন্দরবনে মোট চারবার আগুন লাগলো। বুধবার বাগেরহাটের শরণখোলার পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশন এলাকায় আগুন লেগেছে। এদিন বিকালে ধানসাগর এলাকার বনের ভেতর থেকে কুণ্ডলির আকারে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। স্মরণ করা যেতে পারে, ২৮ মার্চ সন্ধ্যায়, ১৩ এপ্রিল সকালে ও ১৮ এপ্রিল সকালে সুন্দরবনের একই এলাকায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিলো। বন বিভাগের পক্ষ থেকে আগুনের ঘটনাকে পরিকল্পিত বলা হচ্ছে।
বনে আগুন লাগার ঘটনা আমাদের অভিজ্ঞতায় তেমন ছিলো না। কালেভদ্রে বনে আগুন ধরেছে বটে, তবে বিদেশে বিশেষত অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল বলে ভয়ংকর আগুনের যে কথা আমাদের বনাঞ্চলে তেমন আগুন লাগার ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। কিন্তু একই মাসে পরপর চারবার আগুন লাগার ঘটনা বড় ধরনের শংকা তৈরি করেছে বৈকি। বাংলাদেশ সাধারণভাবে বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হিসেবে পরিচিত।
এগুলোর সাথে যদি বনাঞ্চলে আগুন কিংবা দাবানল যুক্ত হয়, তাহলে তা দেশের জন্য এক বাড়তি দুর্যোগ হিসেবে দেখা দেবে। সুতরাং সুন্দরবনে কেনো বারবার আগুন লাগছে, তা খুঁজে বের করা দরকার। প্রথম প্রশ্ন- এটা কি মনুষ্যসৃষ্ট আগুন, নাকি প্রকৃতি তথা বাস্তুতন্ত্রে এমন কোনো পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, যা বনে আগুন লাগার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। আগুন লাগার কারণ মনুষ্যসৃষ্টি হলে তা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। কাঠুরিয়া বা মৌয়ালীদের বিড়ি-সিগারেট থেকে বা অন্য উপায়ে সূত্রপাত হতে পারে আগুনের। কিংবা এমনও হতে পারে, বনসম্পদ চুরির হিসাবে শুভংকরের ফাঁকি দেখানোর উদ্দেশ্যে আগুন ধরিয়ে সম্পদ বিনষ্ট করা হচ্ছে। আগুনের কারণ বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তনজনিতও হতে পারে। সুন্দরবনে লবণাক্ততার বিস্তৃতি এবং বনজীবী মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মতৎপরতার ফলে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, জীববৈচিত্র্যে দেখা দিচ্ছে পরিবর্তন। প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা আগুন লাগার প্রেক্ষাপট তৈরি করে থাকতে পারে। প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে হবে এবং সে অনুযায়ী নিতে হবে ব্যবস্থা।
সুন্দরবন শুধু দেশের প্রধান বনাঞ্চল নয়, এটি ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজও বটে। এই বনাঞ্চলকে বাংলাদেশের ফুসফুসও বলা যেতে পারে, যা আমাদের মুক্ত রেখেছে অনেক দূষণ থেকে। এই ফুসফুসই যদি দূষিত হয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে পুরো শরীর বাঁচবে কীভাবে? সুতরাং যে কোনো উপায়ে একে রক্ষা করতে হবে। শুধু মানুষের দূষণমুক্ত জীবনের স্বার্থেই নয়, বনভূমিকে পশু ও প্রাণীদের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনে এর সঠিক পরিচর্যা করতে হবে। সুন্দরবনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে তাই অশনিসংকেত হিসেবে দেখতে হবে। সিডর ও আইলাবিধ্বস্ত সুন্দরবনের প্রতি মানুষও যদি নির্মম আচরণ করে, তাহলে তা বাঁচবে কীভাবে? আমরা আশা করব, বন বিভাগ সুন্দরবনের আগুনকে শুধুই ‘পরিকল্পিত’ আখ্যা দিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকবে না। আগুনের পুনরাবৃত্তি রোধে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতারও পরিচয় দেবে।