স্টাফ রিপোর্টার: গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর ইস্কাটনের নিজ বাড়ি থেকে শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে পল্টন থানায় দায়ের করা একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। যদিও তিনি ওই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন না। শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করার সময় ডিবি পুলিশ বাড়ির বাবুর্চিকে মারধর করে, কেয়ারটেকারকে গুলি করার হুমকি দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরপর দুপুরে পুলিশ তাকে ঢাকা মহানগর আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করেন। আদালত তাকে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তাকে গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, তার লেখনি কব্জা করতে না পেরেই সরকার তাকে গ্রেফতার করেছে। দলটির পক্ষ থেকে শফিক রেহমানের মুক্তি দাবি করে বলা হয়েছে, তাকে মুক্তি না দিলে কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে। ৮২ বছর বয়স্ক সাংবাদিক শফিক রেহমান সাপ্তাহিক যায়যায়দিন পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। তিনি বিবিসিতেও কাজ করেছিলেন। টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপনার পাশাপাশি পত্রিকায় কলাম লিখতেন তিনি।
গ্রেফতারের বর্ণনা দিয়ে শফিক রেহমানের বাড়ির কেয়ারটেকার আবদুল মতিন মোল্লা সাংবাদিকদের জানান, সকাল সাড়ে ৬টার দিকে তিনজন ব্যক্তি বাড়ির গেটে এসে জানায়, তারা বৈশাখী টেলিভিশন থেকে এসেছেন। স্যারের (শফিক রেহমান) কাছে তারা একটি অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা করবেন। ফলে তাদের আমরা কোনো সন্দেহ করিনি। তাদের হাতে কোনো ক্যামেরাও ছিলো না। আমরা বাড়ির মূল গেট খুলে দিয়ে ভেতরে বসতে দেই। তিনি জানান, তিন ব্যক্তিকে বসতে দেয়ার পর আমরা বাড়ির কেয়ারটেকারের মাধ্যমে বৈশাখী টিভির প্রোগ্রামের লোক এসেছে বলে শফিক রেহমানের কাছে খবর পাঠাই। তিনি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘুম থেকে তাকে তোলে খবরটি দেয়ার পর স্যার আমাদের ওই লোকগুলোকে বসতে এবং চা-নাস্তা দেয়ার কথা বলেন। স্যারের নির্দেশ মতো, লোকগুলোকে বিস্কুট, মিষ্টি ও চা দেয়া হয়। ওই সময় তারা কক্ষে থাকা স্যারের কয়েকটি বই নেড়েচেড়ে দেখছিলেন। আমি তাদের বইপত্র নাড়তে নিষেধ করি। এদিকে আগত লোকগুলোকে অ্যাপায়ন করার কথা বলে স্যার বিছানা ছেড়ে ওয়াশ রুমে যান। সেখানে তিনি সেভ করেন। পরনের শার্টটিও পরিবর্তন করেন। বাড়ির বাবুর্চি আলী আজম জানান, চা-নাস্তা খাওয়ার পর স্যারের দেরি দেখে নিচে বসে থাকা লোক বিরক্ত হয়ে বারবার তাগাদা দিতে থাকেন। একপর্যায়ে তারা বলেন, তাকে দ্রুত নিচে নামতে বলুন। নয়তো আমরাই তিনতলায় গিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করে আসবো। একই কথা তারা বারবার বলছিলেন। এ সময় আমি তাদের অপেক্ষা করার জন্য বলি। এ সময় তারা ধমক দিয়ে আমার হাতে একটি কার্ড দিয়ে দ্রুত স্যারের হাতে পৌঁছাতে বলেন। বাবুর্চি আলী আজম বলেন, আমি কার্ড নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় আমার পেছনে জোর করে ওই তিনজনের মধ্যে একজন নিচতলার সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে পড়ে। আমিও তার পিছু নিয়ে দোতলায় উঠে পড়ি। আমি তাকে ধমক দিয়ে নিচে নামতে বলি। ওই সময় তাদের সাথে থাকা আরও দুজন দোতলায় উঠে পড়েন। ওই মুহূর্তে স্যার (শফিক রেহমান) তৃতীয়তলার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিলেন। স্যার আমাদের কাছে জানতে চান কি হয়েছে? তখন আগেই দোতলায় উঠে যাওয়া এক ব্যক্তি স্যারকে বলেন, আমরা ডিবি পুলিশের সদস্য। আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে। আলী আজম বলেন, স্যার তাদের কাছে জানতে চান তার নামে কোনো ওয়ারেন্ট আছে কি-না? তারা বলেন, নেই। স্যার প্রশ্ন করেন- তাহলে কেন আমাকে নিয়ে যাবেন? এ সময় ডিবি পুলিশের সদস্যরা জানান, আপনি পরে সবকিছু জানতে পারবেন। এখন আমাদের সাথে চলেন। আলী আজম বলেন, তখন আমাদের সন্দেহ হয়। আমরা ডিবি পুলিশের পরিচয়পত্র দেখতে চাই। তাকে নিয়ে যেতে বাধা দিই। বাবুর্চি আলী আজম বলেন, আমরা বাধা দিলে একজন আমার মাথার বামপাশে একটি ঘুষি মারে। তখন আমি পড়ে যাই। এ সময় ডিবি পরিচয় দেয়া লোকগুলো কেয়ারটেকার মতিন মোল্লাকে একটি পিস্তল দেখিয়ে গুলি করার হুমকি দেন। সকাল ৮টা ২৫ মিনিটের সময় তারা স্যারকে গেটের বাইরে নিয়ে গিয়ে বাড়ির কিছুদূরে থাকা একটি শাদা মাইক্রোবাসে করে হলিফ্যামেলি হাসপাতালের রাস্তার দিকে চলে যায়। বাড়ির গৃহকর্মী হনুফা বেগম সাংবাদিকদের জানান, বাড়িতে অতিথিরা এলেই নাস্তা দেয়া হয়। তাদেরও নাস্তা দেয়া হয়। যে তিনজন বাসায় এসেছিলেন তারা এসেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। স্যার তখন সেভ করছিলেন। তিনি তাদের চিৎকার শুনে খুব বিরক্ত প্রকাশ করছিলেন। এদিকে গতকাল সকালে শফিক রেহমানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে গণমাধ্যমকর্মী ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের ভিড়। পরিবারের সদস্যরা তার বিষয়ে খোঁজখবর নেয়ার জন্য বিভিন্ন স্থানে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলেন। অন্যদিকে তাকে গ্রেফতারের খবর পেয়ে তার আত্মীয়স্বজনরা তার বাড়ি এবং ডিবি পুলিশের কার্যালয়ের সামনে ভিড় করেন। ওদিকে শফিক রেহমানকে গ্রেফতারের খবর পেয়ে বেলা সোয়া ১০টায় নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ। এরপর তিনি ছুটে যান শফিক রেহমানের ইস্কাটনের বাসভবনে। ততোক্ষণে সেখানে ভিড় করেন গণমাধ্যমকর্মীরা। বাসভবনের দোতলার কক্ষে রিজভী আহমেদ বসলে সেখানে চোখ মুছতে মুছতে এসে বসেন তালেয়া রহমান। এ সময় রিজভী আহমেদ তাকে সান্ত্বনা ও সাহস দেন। বেলা ১১টার দিকে তালেয়া রহমান নাস্তা ও ওষুধ নিয়ে ডিবি কার্যালয়ে যান। তার কাছ থেকে নাস্তা ও ওষুধ গ্রহণ করেন ডিবি পুলিশের কয়েকজন সদস্য। তবে ওই সময় তালেয়া রহমান তার স্বামী শফিক রেহমানের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেননি। সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর তিনি বাড়িতে ফিরে যান।
এদিকে যোগাযোগ করা হলে ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মারুফ হোসেন সরদার সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রীর সন্তান ও তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে আমেরিকায় অপহরণের অভিযোগে পল্টন থানায় গত বছরের ৩ আগস্ট পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করে। মামলা নম্বর-৩। ওই মামলার এজাহার নামীয়সহ কয়েকজন অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছিলো। ওই মামলায় ষড়যন্ত্রকারী ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে সন্দেহভাজন হওয়ার কারণে শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এদিকে শফিক রেহমানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার প্রমাণ আছে বলে দাবি করেছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। যুক্তরাষ্ট্রে তার সম্পর্কে তথ্য পেতে এফবিআই কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়ার অপরাধে এক বিএনপি নেতার ছেলের কারাদণ্ডের মামলা থেকেই ওই সব প্রমাণ এসেছে বলে এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন তিনি। গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর ইস্কাটনের বাসা থেকে বিএনপিঘনিষ্ঠ প্রবীণ এই সাংবাদিককে গ্রেফতারের পর রাতে ওই পোস্ট দেন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তার তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টা জয়। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে জয়কে অপহরণের চক্রান্তের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের অনুমতিতে শফিক রেহমানকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সজীব ওয়াজেদ জয় বলছেন, তার মা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে থাকায় এবং তাকে তিনি সহযোগিতা করায় এখন ঝুঁকির মধ্যে আছেন তিনি। ফেইসবুকে জয় লিখেছেন, কতো হরহামেশা আপনি এমন কোনো লোককে পাবেন যে আপনাকে হত্যার চেষ্টা করছে? আমার ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে আমার জানার বাইরেও এটা প্রায়শই হচ্ছে। আমি অপরাধী বা কোনো খারাপ মানুষও নই যে এমনটা হবে।