আজ লাশ তোলা হবে : ৩ এপ্রিল সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট
স্টাফ রিপোর্টার: থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পর এবার সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যা মামলা তদন্তের ভার। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সিআইডির হাতে মামলাটি হস্তান্তর করা হয়। কুমিল্লা জেলা পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এদিকে আদালতের নির্দেশে আজ বুধবার কবর থেকে তনুর লাশ তুলে ফের ময়না তদন্ত করা হবে।
গতকাল দুপুরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা তনু হত্যার বিচারের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। বেলা ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ওই এলাকা দিয়ে কোন যান চলাচল করেনি। ওই বিক্ষোভ-সমাবেশ থেকে আগামী ৩ এপ্রিল সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ শিক্ষার্থীরা এ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। তবে ওই দিনের এইচএসসি পরীক্ষা ধর্মঘটের আওতামুক্ত থাকবে বলেও ঘোষণা দেয়া হয় সমাবেশ থেকে।
গত ২১ মার্চ তনু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছিলো কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ও সেনানিবাস ফাঁড়ির কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলামকে। গত শুক্রবার হত্যামামলাটি পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডিবির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএম মনজুর আলম ওই মামলা তদন্ত করছিলেন। এ নিয়ে ২১ মার্চ থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ২ দফা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও দফতর পরিবর্তন করা হলো। কিন্তু তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। কাউকে গ্রেফতারও করতে পারেনি পুলিশ।
গতকাল বিকালে ৱ্যাব ১১’র একটি দল কুমিল্লা সেনানিবাসের পাউয়ার হাউস এলাকার কালভার্ট সংলগ্ন যে স্থানে কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর লাশ পড়েছিলো সেখান থেকে আলামত হিসেবে মাটি সংগ্রহ করেছে। রাত পৌনে ৯টায় ফোনে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কুমিল্লাস্থ ৱ্যাব ১১র অধিনায়ক মেজর খুরশীদ আলম। তিনি বলেন, মামলার তদন্তের স্বার্থে আলামত হিসেবে ওই স্থান থেকে মাটি সংগ্রহ করে আনা হয়েছে।
জানা গেছে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিত্সকসহ সংশ্লিষ্টরা আজ সকালে মুরাদনগর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে যাবেন। সেখানে তনুর লাশ উত্তোলন করা হবে।
মামলা দায়েরের ৯দিন পেরিয়ে গেলেও তনু হত্যার কোনো রহস্য উদঘাটন, আসামি শনাক্তকরণ বা গ্রেফতার না হওয়ায় অন্যান্য দিনের মতো গতকালও কুমিল্লা মহানগরীর কান্দিরপাড় পূবালী চত্বর, কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড মডেল কলেজ, ইবনে তাইমিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ডিগ্রি শাখাসহ বিভিন্নস্থানে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করে।
গতকাল বিকালে ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারের পক্ষ থেকে তনু হত্যার বিচার দাবিতে পূবালী চত্বরে গণস্বাক্ষর নেয়া হয়। সকাল ১১টার দিকে তনুর রুহের মাগফেরাত কামনা করে ভিক্টোরিয়া কলেজের শহীদ মিনারের পাশে ‘তনু মঞ্চে’ মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে তার সহপাঠীরা। গতকাল সিআইডির কুমিল্লার বিশেষ পুলিশ সুপার ড. নাজমুল করিম খানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। এ সময় কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মো. আলী আশরাফ ভূঁইয়া, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) মো. আবদুল্লাহ আল-মামুন ও মামলার সাবেক তদন্তকারী কর্মকর্তা একেএম মনজুর আলম সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
ড. নাজমুল করিম খান সাংবাদিকদের বলেন, তনু হত্যার রহস্য উদঘাটনে আমরা কাজ করছি এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মামলার অগ্রগতি ও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। বুধবার (আজ) সকাল ১০টার দিকে তার লাশ উত্তোলন করা হবে।
শাহবাগে অবরোধ, ৩ এপ্রিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট: তনু হত্যার বিচার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তখন ওই এলাকায় সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে অবরোধ প্রত্যাহার করে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন তারা। এর আগে বেলা একটার দিকে অবরোধ শুরু হয়।
অবরোধের একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দিতে লাঠিপেটা করে পুলিশ। এ সময় দু শিক্ষার্থী আহত হয়। তারা হলেন- আশিকুল ইসলাম ও মন্টু। এই দুজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে। অবরোধে অংশ নেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফসানা জেরিন বলেন, ‘তনুকে ধর্ষণের মতো ঘটনা আমার অন্য বন্ধুদের বেলায়ও তো ঘটতে পারে। আর যেন এই ঘটনা না ঘটে, সে দাবি নিয়েই আমরা শাহবাগ অবরোধ করেছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী সৌফিয়া ইসলাম বলেন, ‘তনু হত্যার সঠিক বিচার যেন পাই। প্রতিদিন আর যেন বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা না ঘটে। এ জন্য আমরা সমবেত হয়েছি।’ ভিকারুন নিসা নূন স্কুলের শিক্ষার্থী মোহনা আখন্দ বলেন, ‘ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে তারা এখানে এসেছেন। ‘আমরা তনুর ভাই-বোন, তনু হত্যার বিচার চাই’, ‘শেষবারের মতো বলছি সংযত হও’ এ রকম নানা পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন হাতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী অবরোধ ও বিক্ষোভে অংশ নেন। কর্তব্যরত একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, যানজট যাতে না হয়, এ জন্য শিক্ষার্থীদের সরে যাওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু তারা শুনছে না।
তনুর হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন বেসরকারি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুরে রাজধানীর বাড্ডায় আফতাবনগর-সংলগ্ন প্রগতি সরণিতে এই প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষার্থী অংশ নেন। শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ কর্মসূচির কারণে বেলা দেড়টা থেকে ১টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত ওই সড়কের এক পাশে যান চলাচল কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়।
শাহবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক বলেন, দুপুরে থেকে শিক্ষার্থীরা শাহবাগে সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে রাখে। এতে যান চলাচল বন্ধ থাকায় সাধারণ লোকজনের ভোগান্তি হয়। এ সময় আমরা অনেক বুঝিয়ে তাদেরকে ওখান থেকে সরাতে চেষ্টা করছি কিন্তু তারা সরেনি। পরে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তারা অবরোধ তুলে নিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। তিনি শিক্ষার্থীদের সাথে হাতাহাতির বিষয়টি অস্বীকার করেন।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিক্ষোভ: তনু হত্যার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। গতকাল বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় সংগঠনটির সভাপতি গোলাম কুদ্দুস আগামী ৪ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবার তনু হত্যাকারীর বিচারের দাবিতে স্মারকলিপি দেয়ার কথা জানান। সমাবেশ শেষে টিএসসি থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়।
গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে বিক্ষোভ: তনুর ওপর বর্বরোচিত ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে রাজধানীর গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার দুপুরে ক্যাম্পাসে এ বিক্ষোভ করে তারা। এ সময় তারা অবিলম্বে তনুসহ সকল নারীর প্রতি ধর্ষণ, নিপীড়ন ও হত্যার বিচার এবং সকল ক্ষেত্রে নারী নিরাপত্তা দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
তনু হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তে জনগণের সহায়তা চায় পুলিশ: পুলিশ সদর দফতর থেকে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, কলেজ ছাত্রী তনুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের আসামি গ্রেফতার সংক্রান্তে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিবর্গের আন্দোলনের বিষয়টির প্রতি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স মানুষের ওই অনুভূতি ও দাবিকে যথাযথভাবে সম্মান করে। ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করে বিশেষজ্ঞ ইউনিট সিআইডিকে এই হত্যাকাণ্ডে তদন্তের ভার দেয়া হয়েছে। সাথে জেলা পুলিশ এবং গোয়েন্দা পুলিশও কাজ করছে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, তনু হত্যাকাণ্ড প্রকাশ্যে ঘটেনি। তাই সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সাক্ষ্য সংগ্রহ করা সময় সাপেক্ষ বিষয়। তনু হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত আসামিকে চিহ্নিত করেই তাকে গ্রেফতার করার ব্যাপারে আমরা প্রত্যয়ী। তবে এটা অবশ্যই সময় সাপেক্ষ।
প্রসঙ্গত, তনু কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় গত ২০ মার্চ সন্ধ্যায় খুন হয়। এ ঘটনায় নিহত তনুর পিতা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহায়ক ইয়ার হোসেন বাদী হয়ে গত ২১ মার্চ অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে কোতয়ালী মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।