মাজেদুল হক মানিক: সবজি চাষের পাশাপাশি মেহেরপুর জেলার কৃষকদের অনেকেই লালশাক বীজ উৎপাদন করছেন। বিক্রি নিশ্চয়তা ও ভালো দাম পেয়ে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। তাই এটিকে লাল সোনা বলে আখ্যায়িত করেন লালশাক বীজ চাষিরা। কৃষি অফিসের তদারকি ও মাড়াই যন্ত্র পেলে এ বীজ চাষ কৃষিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে মনে করেন এখানকার চাষিরা।
জানা গেছে, বছর সাতেক আগে থেকে মেহেরপুর জেলার সবজি উৎপাদনখ্যাত গাংনী উপজেলার সাহারবাটি গ্রামের কৃষকরা প্রথমে লালশাকের বীজ উৎপাদন শুরু করেন। তাদের সফলতায় স্বল্প পরিসরে হলেও চাষ ছড়িয়ে পড়ে জেলার বিভিন্ন মাঠে। উৎপাদিত বীজ স্থানীয় বীজ ব্যবসায়ী ছাড়াও বিভিন্ন বীজ কোম্পানি ভালো দাম দিয়ে কিনে নেয়ায় লাভবান হতে থাকেন চাষিরা। অন্য ফসলের পাশাপাশি লাশশাক বীজ উৎপাদন করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন এ অঞ্চলের চাষিরা।
সাহারবাটি গ্রামের লালশাক বীজ চাষিরা জানান, ধানসহ বিভিন্ন ফসলে বারবার লোকসানের ফলে চাষিরাই বেছে নিয়েছেন বিকল্প চাষ। এতে কাঙ্ক্ষিত ফলন ও লাভ হচ্ছে। আশ্বিন-কার্তিক মাসে ক্ষেতে লালশাক বীজ বপণের পর প্রয়োজনীয় সার, কীটনাশক ও আগছা দমনসহ নানা পরিচর্যায় বেড়ে ওঠে গাছ। খাওয়া উপযোগী লালশাক আকারে ছোট হলেও বীজ উৎপাদন করা গাছ প্রায় তিন ফুট উচ্চতা পর্যন্ত বাড়ে। ৪-৫ মাস পরে মাঘ থেকে ফাল্গুন মাসে এর বীজ সংগ্রহের সময় আসে। প্রতিটি গাছের বিভিন্ন ডালপালায় শীষ আসে। এই শীষ কেটে রোগে শুকিয়ে বীজ বের করা হয়। প্রতি বিঘায় গড়ে ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হয়। ফলন ৬-১০ মণ পর্যন্ত। চলতি মরসুমে প্রতিমণ ৪-৫ হাজার টাকা দরে বিক্রি করতে পারছেন কৃষকরা। এতে মাত্র ৫ মাসে প্রতি বিঘায় লাভ ন্যূনতম ১৫ হাজার টাকা। তবে বীজ উৎপাদন প্রান্তিক চাষিদের কাছে ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও লাভের আশায় তারা চাষ করছেন।
সাহারবাটি চারচারা বাজারের বীজ ব্যবসায়ী হাফিজুল ইসলাম জানান, চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দামের নিশ্চয়তা দিয়ে বীজ উৎপাদন করানো হচ্ছে। কৃষকদের কাছ থেকে তিনি চলতি মরসুমে প্রতিমণ বীজ কিনছেন ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এই বীজ রোদে শুকিয়ে মান নিশ্চিত করে তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। কয়েকটি কোম্পানি ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) স্থানীয় অফিসও বিভিন্ন সময়ে তার কাছ থেকে বীজ কেনে। এ বীজ মাঠ পর্যায়ে লালশাক চাষের জন্য বিক্রি করে থাকেন ব্যবসায়ীরা। লাল সোনায় অনেক কৃষকের ভাগ্য বদল করলেও এ চাষের কিছু সমস্যার কথা জানালেন কৃষকরা।
সাহারবাটি গ্রামের চাষি তুহিন রেজা জানান, চাষিদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও বুদ্ধিতে লালশাক বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে। এ চাষের প্রধান সমস্যা হচ্ছে গোড়া পচা রোগ ও মাড়াই। ছত্রাকের আক্রমণে ক্ষেতে গাছের গোড়া পচা রোগ ও ছত্রাকের আক্রমণে পাতার নিচে শাদা আবরণ সৃষ্টি হয়। এতে ফলন বিপর্যয় হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সব গাছ মারা যেতে পারে। স্থানীয় কীটনাশক ব্যবসায়ী ও কীটনাশক কোম্পানির প্রতিনিধিদের পরামর্শ সমস্যা থেকে উত্তরণের একমাত্র ভরসা। এতে যত্রতত্র কীটনাশকের প্রয়োগ বেড়ে গেলেও সব সময় কাঙ্ক্ষিত ফল মিলছে না। তবে বরাবরের মতোই এবারো কৃষি অফিস মাঠপর্যায়ে চাষিদেরকে সহযোগিতা করে বলে জানালেন মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক। এদিকে বীজ মাড়াই করার কোনো আধুনিক যন্ত্র না থাকায় চাষিরা চরম সমস্যায় রয়েছেন। কৃষিতে আধুনিক অনেক যন্ত্রপাতির ব্যবহার হলেও লালশাক মাড়াই যন্ত্রের কোনো ব্যবস্থা নেই। এক্ষেত্রে চাষিরা ক্ষেত থেকে শাক গাছ কেটে সড়কের ওপরে ফেলে রাখেন। রোদে শুকিয়ে যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে বীজ বের হয়। এতেও প্রায়ই বিপত্তি দেখা দেয়। শাকের পিচ্ছিলতার কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে সড়কে চলালকারী বাস, ট্রাক, মোটরসাইকেলসহ ছোট ছোট যানবাহন। লালশাক বীজ উৎপাদনের বিষয়ে চাষিদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসার রইচ উদ্দীন বলেন, শুধু বীজ উৎপাদন নয় চাষের সব ক্ষেত্রেই সহযোগিতা করছে কৃষি বিভাগ। আধুনিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের জন্য তিনিও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।