আইন থাকলেই যেমন আইনের শাসন বিদ্যমান বলা যায় না, তেমনই অধিকার থাকলেও অসচেতনতায় তা আদায় অনেকটাই অবান্তর হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে আমাদের দেশে শ্রমআইনে শ্রমিকদের যে অধিকার দিয়েছে তা না জানার কারণে মালিকশ্রেণি পদে পদে ঠকাচ্ছে। সুযোগ নিচ্ছে পোটুয়া। কখনো কখনো নামমাত্র অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকের বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবরের হাতে কিছু অর্থ তুলে দিলেও ভাবটা এমন যেন, তিনি দয়া করছেন। অথচ ক্ষতিপূরণ পাওয়াটা অধিকার।
ঘরে বাইরে, কল-কারখানায় কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির অধিনে কাজ করার সময় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই হোক, আর অসর্তকতাতেই হোক, অঙ্গহানি থেকে শুরু করে প্রাণহানির উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের বিধান দেশে প্রচালিত শ্রমআইনে রয়েছে। এ আইন সম্পর্কে ক’জন শ্রমিক, শ্রমিকের পরিবার জানে? না জানার কারণেই মূলত মালিকশ্রেণি নানা কৌশলে ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা চালায়। কখনো কখনো কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক বা তত্ত্বাবধায়ক বিবেকের তাড়নায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক বা শ্রমিকের পরিবারের হাতে নামকাওয়াস্তে আর্থিক সহযোগিতা করেন। অথচ বিষয়টি বিবেকের তাড়নার চেয়ে আইনগত তাগিদই বেশি। অনেকে ওই দয়া নিয়েই মালিককে দয়াবান বলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। কারণ, ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার সম্পর্কে ওরা অসচেতন।
অবশ্যই কাল কারখানায় নিযুক্ত শ্রমিকের স্বাস্থ্য, শারীরিক, মানসিক, জানের নিরাপত্তার বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই কলকারখানার যে বিভাগে ঝুঁকি, সেখানে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অথচ মাঝে মাঝেই খবর পাওয়া যায়, কাজ করতে গিয়ে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে অঙ্গহানি হয়েছে। প্রাণ ঝরেছে। এইতো ক’দিন আগে চুয়াডাঙ্গা জীবননগরের দেহাটির কনটেক কনস্ট্রাকশনে পিলার তৈরির কারখনায় পিলার পড়ে এক শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। যেখানে বড় প্রস্তুতকৃত বড় খুঁটি ফসকে পড়তে পারে, সেখানে শ্রমিক নিরাপত্তা ছিলো না কেন? থাকলেও শ্রমিক কেন সে ব্যবস্থা গ্রহণ না করেই কাজ করলো?
এদিকে দুর্ঘটনায় আহত ট্রাক চালক চুয়াডাঙ্গা নূরনগর হাজি মোড়ের সোরাপ আলী মারা যাওয়ার পর কয়েকটি প্রশ্ন উঠেছে। দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর চিকিৎসার সময় মালিক পক্ষ খোঁজ খবর রেখেছে? আর্থিক সহযোগিতা করেছে? প্রশ্নগুলো শ্রমিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট হলেও এক শ্রমিকই ওই ট্রাকচালক নিহত হওয়ার খবর পত্রিকায় যাতে না ওঠে, সেই চেষ্টা করতে থাকেন। সাংবাদিক ছবি নিলে হুমকি ধামকি দেন। এক পর্যায়ে গ্রামের সাধারণ মানুষকে উস্কে দিয়ে সাংবাদিককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেতেও ছাড়েননি তিনিসহ তার সাথে থাকা কয়েকজনের একটি চক্র। কেন? ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক পরিবার যাতে ক্ষতিপূরণ না পায় সে জন্য? যে শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক পরিবারের স্বার্থ সংরক্ষণের বদলে মালিকের স্বার্থ হাসিলে মত্ত থাকেন, তাকে ঠিক কী বলে ধিক্কার জানানো উচিত?
একজন সাংবাদিককে সংবাদ সংগ্রহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি মানে সমাজেরই ক্ষতি করা। অথচ হুজুগে মেতে কোনো কোনো সমাজের মানুষ সমাজের চরম ক্ষতি করে লজ্জা আড়ালের অপচেষ্টায় মেতে ওঠে। নূরনগর হাজি মোড়ের আমজনতার নিশ্চয় ভুল ভেঙেছে। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেমন কাম্য নয়, তেমনই শ্রমিক অধিকার পদে পদে ধুলণ্ঠিত হোক তা মেনে নেয়া যায় না। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক, শ্রমিক পরিরবার যাতে প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ পায়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সমাজেরও।