বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থন দিয়ে বেকায়দায় মন্ত্রী-এমপিরা : হার্ড লাইনে কেন্দ্র

স্টাফ রিপোর্টার: পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থীদের সমর্থন করে বেকায়দায় রয়েছেন মন্ত্রী-এমপিরা। গতকাল ঢাকা থেকে প্রকাশিত একাধীক পত্রিকায় এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে চুয়াডাঙ্গার রাজনৈতিক অঙ্গনেও উত্তাপ ছড়ায়।
দফায় দফায় হুশিয়ারি, কারণ দর্শাও নোটিশ ও বহিষ্কারের ঘোষণা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত প্রায় ৬৮ পৌরসভায় মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী তথা স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর ও চুয়াডাঙ্গা সদরসহ ১৫ জনের গলায় জয়ের মালা উঠেছে। বাকিরা পরাজিত হয়েছেন। পরাজিতদের রাজনৈতিক ভাগ্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এমনকি বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থীদের মদতদাতা মন্ত্রী-এমপিদেরও ভাগ্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দায়িত্বশীল সূত্র। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থীরা পরাজিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থীদের পেছনে থেকে যেসব নেতা মদত দিয়েছেন, তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিদ্রোহী প্রার্থী নয়, তাদের সমর্থক মন্ত্রী-এমপিদের স্থানীয় জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে কি-না- এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, আসলে তা নয়, নৌকার বিপক্ষে গিয়েই বিদ্রোহীদের ভরাডুবি হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থীদের মদত দেয়া নিয়ে আলোচনায় ছিলেন পাবনায় ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলু ও সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স। দিনাজপুরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, সিরাজগঞ্জে সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপন, জামালপুরে সাবেক তথ্যমন্ত্রী সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, নীলফামারীর সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা, গাইবান্ধার আলোচিত সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটন ও চট্টগ্রামে এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। তারা আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিরোধিতা করেন। মন্ত্রী-এমপির আশীর্বাদ ছিলো বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রতি। এসব পৌরসভায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পাশাপাশি বিএনপির মেয়র প্রার্থীরাও ভালো ফলাফল করেছেন। পাবনা সদর পৌরসভায় মেয়র পদে প্রথমে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান তসলিম হাসান সুমন। এক ঘণ্টার মধ্যে এ মনোনয়ন পরিবর্তন করে দেয়া হয় রাকিব হাসান টিপুকে। টিপু আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মন্ত্রীর সমর্থক বলে পরিচিত। এখানে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী নেতা কামিল হোসেন। জনশ্রুতি রয়েছে কামিল হোসেনের প্রতি আশীর্বাদ ছিলো জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলু এবং সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্সের। তারা সরাসরি কোনো সমর্থন না জানালেও বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থীর প্রতি তাদের আশীর্বাদ ছিলো বলে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড মনে করে। এখানে আওয়ামী লীগ মনোনীত বা বিদ্রোহী স্বতন্ত্র কোনো প্রার্থীই জয়ের মুখ দেখতে পারেননি। জয়ী হয়েছেন বিএনপির বিদ্রোহী স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী কামরুল হাসান মিন্টু।
দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী ছিলেন শাহজাহান আলী সরকার পুতু। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারের ভাই খাজা মইনউদ্দিন। এ পৌরসভায় মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান মেয়র গোলাম মর্তুজা মানিক। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান সাবেক মেয়র হালিমুল হক মিরু। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাসের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এখানে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রহিম। আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড মনে করে আবদুর রহিমকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপন। তবে এই পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হালিমুল হক মিরুই মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। বিদ্রোহী প্রার্থীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে স্থানীয় সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের প্রার্থীকে প্রত্যাখ্যান করেছে সেখানকার ভোটাররা। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন শাহনেওয়াজ শাহেনশা। এ মনোনয়ন মেনে নিতে পারেননি জামালপুর-১ আসনের সরকারি দলের সংসদ সদস্য এবং সাবেক তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। তিনি মেয়র হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন তার ভাতিজা নুরুন্নবী অপুকে। নিজের আত্মীয়-স্বজন ও অনুসারী দলীয় নেতাকর্মীদের মাঠে নামান ভাতিজার পক্ষে। কিন্তু আবুল কালাম আজাদের প্রতি আস্থা রাখতে পারেননি স্থানীয় জনগণ। দলীয় প্রার্থীকেই জয়ী করেছেন তারা। চট্টগ্রামের রাউজানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান দেবাশীষ পালিত। কিন্তু তাকে মেনে না নিয়ে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হিসেবে মাঠে নামেন মীর মুনসুর আলম। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় সরকারি দলের সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিলো মুনসুর আলমের প্রতি। কিন্তু এখানেও আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী দেবাশীষ পালিত জয়ী হয়েছেন। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী ছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। তার সাথে স্থানীয় আলোচিত সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের বিরোধ ছিলো। এ কারণে লিটন বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেন। লিটনের অনুসারী নেতাকর্মী ও সমর্থকরা বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থীর হয়ে কাজও করেন। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী দুই মেয়র প্রার্থীই ধরাশায়ী হন। জয়ের মালা গলায় পরেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী।
উত্তরাঞ্চলের জেলা নীলফামারীর জলঢাকায় আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী ছিলেন আবদুল ওয়াহেদ বাহাদুর। এই মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান করে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হন আওয়ামী লীগ নেতা ইলিয়াস হোসেন বাবলু। এ বাবলুর প্রতি সরকারদলীয় সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফার সমর্থন ছিলো বলে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড মনে করে। শাসক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে এখানেও জয়ী হয়েছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী ফাহমিদ ফয়সাল চৌধুরী।
দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে যে ২১ জন এমপি পৌর নির্বাচনে বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থীদের নানা কৌশলে সমর্থন করেছেন তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে তারা মনোনয়ন পাবেন কি-না তা নিও সংসয় দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে গত বৃহস্পতিবার গণভবনে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কার্যনির্বাহী সংসদের শীর্ষ নেতাদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর বিশদ আলোচনা হয়েছে। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সেতু ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় নেতারা পৌরসভা নির্বাচনের আদ্যোপান্ত নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছেন। ওবায়দুল কাদের পৌর নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের প্রচার কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। দলীয়সূত্র বলেছে, আগামী ৯ জানুয়ারি শনিবার দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এ ব্যাপারে বিশদ আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যারা কাজ করেছেন তাদের আগামী সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না দেয়ার মনোভাবই ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
তাদের মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম-৪ আসনের মঞ্জুরুল আলম, চট্টগ্রাম-৬ আসনের এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১৫ আসনের এমপি অধ্যাপক ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভী, বগুড়া-৫ আসনের হাবিবুর রহমান, পাবনা-৩ আসনের মকবুল হোসেন, যশোর-৩ আসনের কাজী নাবিল আহমেদ, চাঁদপুর-৪ আসনের ড. শামসুল হক ভূঁইয়া, ঠাকুরগাঁও-১ আসনের রমেশ চন্দ্র সেন, নড়াইল-১ আসনের কবিরুল হক মুক্তি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের গোলাম রাব্বানী, কুষ্টিয়া-৪ আসনের আবদুর রউফ, দিনাজপুর-১ আসনের মনোরঞ্জন শীল গোপাল, দিনাজপুর-৬ আসনের শিবলী সাদিক, গাইবান্ধা-৪ আসনের আবুল কালাম আজাদ, বরগুনা-১ আসনের অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, সুনামগঞ্জ-৫ আসনের মুহিবুর রহমান মানিক, চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের আলী আজগার টগর, সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের হাসিবুর রহমান স্বপন, মানিকগঞ্জ-১ আসনের এএম নাঈমুর রহমান দুর্জয় ও মৌলভীবাজার-২ আসনের আবদুল মতিন।