পিটুনির সময় ৪ লক্ষাধিক টাকা ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগে ইউপি মেম্বারসহ দুজনকে আটক করেছে পুলিশ
আলমডাঙ্গা ব্যুরো: চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় গরুচোর সন্দেহে ভোদুয়া গ্রামে ৬ ব্যক্তি গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। তবে তারা সবাই নিজেদের গরুব্যবসায়ী বলে দাবি করেছেন। গতকাল শনিবার ভোররাতে আলমডাঙ্গা উপজেলার ডাউকী ইউনিয়নের ভদুয়া গ্রামের যমুনা মাঠে গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। পুলিশ আহত ছয়জনকে উদ্ধার করে আলমডাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে।
গণপিটুনির সময় তাদের নিকট থাকা ৪ লক্ষাধিক টাকা ছিনিয়ে নেয়ার পালটা অভিযোগ তুলেছেন তারা। তাদের এ অভিযোগে পুলিশ গতকাল সন্ধ্যায় ভোদুয়া গ্রামের ইউপি সদস্য বাংলা মেম্বার ও চুরি যাওয়া গরুমালিক আমজাদ হোসেনকে পুলিশ হেফাজতে নিয়েছে। গণপিটুনির শিকার ৬ জন হলেন পিকাপভ্যানের ড্রাইভার চুয়াডাঙ্গা ইসলামপাড়ার শহিদুল ইসলামের ছেলে শাকিল (২০), দামুড়হুদা উপজেলার বড় দুধপাতিলা গ্রামের মৃত ইসমাইলের ছেলে আবুল কালাম (৫০), একই গ্রামের মৃত নূর ইসলামের ছেলে সাহেব আলী (৪০), মিনার মণ্ডলের ছেলে আব্দুল গাফফার (৩৫), একই গ্রামের মৃত আব্দুস সামাদের ছেলে ইনতাজুল (৩৫) ও ইন্তাজের শ্বশুর উজিরপুর গ্রামের মৃত আফছার আলীর ছেলে খাকছার আলী (৫৫)। এদের মধ্যে ইন্তাজ-খাকছার, আবুল কালাম ও সাহেব আলীকে হারদী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
পুলিশ ও এলাকাবাসীসূত্রে জানা গেছে, গত ২২ ডিসেম্বর দিনগত রাতে অজ্ঞাত সঙ্ঘবদ্ধ চোরচক্র আলমডাঙ্গা উপজেলার ভোদুয়া গ্রামের আঈন উদ্দীন চৌধুরীর ছেলে জিন্নাহ চৌধুরীর প্রায় দেড় লাখ টাকা মূল্যের ২টি গরু ও একই গ্রামের আহাতাব আলীর ছেলে কাদের আলীর প্রায় ৩ লাখ টাকা মূল্যের ৪টি গরু চুরি করে নিয়ে যায়। একই রাতে গ্রামের ৬টি গরু চুরির মতো আতঙ্কজনক ঘটনায় গ্রামবাসী শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা এ ঘটনার পর থেকে রাতে বেশ সতর্ক অবস্থায় ছিলো।
গত শুক্রবার রাতে আলমডাঙ্গার ভদুয়া গ্রামের আমজাদ হোসেন ও রেজাউল ইসলামের দুটি গরু চুরি হয়। রাতেই গরুচুরির বিষয়টি টের পেয়ে কয়েকজন গ্রামবাসী মসজিদের মাইকে বিষয়টি প্রচার করে দ্রুত বের হওয়ার আহ্বান জানায়। মাইকে প্রচারের পর গ্রামবাসী রাত পৌনে ৩টার দিকে আলমডাঙ্গা-জামজামি সড়কে নেমে পড়ে। সে সময় ভোদুয়া গ্রামের কেউ মোবাইলফোনে গরুচুরির বিষয়টি পার্শ্ববর্তী বিনোদপুর গ্রামে ছড়িয়ে দেয়। ফলে বিনোদপুর গ্রামবাসীও রাস্তায় নেমে পড়ে। যমুনার মাঠে গরুসহ একটি ট্রাক দেখতে পায় তারা। যমুনা মাঠের মধ্যে পৌঁছে রাস্তার পাশের গাছের সাথে চুরি হওয়া ২টি গরু বাঁধা অবস্থায় দেখতে পান। সে সময় তারা গরুর নিকটবর্তীতে রাস্তায় একটি পিকাপভ্যান দেখতে পায় (ঢাকা মেট্রো-ন-১৮-৫০২৩)। পিকাপভ্যানটিকে ঘেরাও করে গ্রামবাসী ৫ যাত্রী ও ড্রাইভারকে নামিয়ে নিয়ে জেরা শুরু করে। গ্রামবাসীর হাতে পাকড়াও পিকাপভ্যানের ৫ যাত্রী নিজেদেরকে গরু ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে জানায় তারা গরু কিনতে জয়পুরহাট যাচ্ছে। গরুব্যবসায়ী পরিচয় পেয়ে গ্রামবাসী ধারণা করে নেয় এরাই গরুচোর। চুরি করা গরু নিতে পিকাপ নিয়ে এসেছে। এমনটা ভেবে নিয়ে গ্রামবাসীরা ড্রাইভারসহ ৬ জনকে গণধোলাই দিতে শুরু করে। এরই মধ্যে বিনোদপুরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের মানুষ এ নির্মম পিটুনিতে যোগ দেয়।
খবর পেয়ে আলমডাঙ্গা থানার পুলিশ ওই ৬ জনকে উদ্ধার করে আলমডাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়। আহত ছয়জনের মধ্যে শামীম ও গাফফারকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে। বাকি ৪ জন পুলিশ পাহারায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন ইনতাজুল ইসলাম দাবি করেন, ট্রাকে করে তারা জয়পুরহাট জেলায় গরু কিনতে যাচ্ছিলেন। আলমডাঙ্গা-জামজামি সড়কে যাওয়ার সময় যমুনার মাঠে ভোদুয়া গ্রামের লোকজন পাউয়ারটিলার দিয়ে রাস্তা অবরোধ করে। এরপর চালকসহ তাদের ট্রাক থেকে নামিয়ে লাঠিসোঁটা দিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয় এবং তাদের কাছে থাকা গরু কেনার ৫ লাখ ৯০ হাজার ৭০০ টাকা ও ছয়টি মোবাইলফোন ছিনিয়ে নেয়। সেই সাথে তাদের বহনকারী ট্রাকটিও ভাঙচুর করে তারা। অনেক অনুনয়-বিনয় করেও কোনো লাভ হয়নি।
হাউলী ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী শাহ মিন্টু জানান, চোর সন্দেহে গণপিটুনির শিকার ৫ জনই প্রতিষ্ঠিত গরুরব্যাপারী। এদের মধ্যে ইনতাজুল ৩টি ট্রাকের মালিক। তারা দেশের বিভিন্ন এলাকার হাট থেকে গরু কিনে এনে চুয়াডাঙ্গার হাটগুলোতে বেচা-কেনা করেন। ভোদুয়া গ্রামে গরু চুরির ঘটনা ঘটলেও ঘটে থাকতে পারে। তবে পিটুনি দিয়ে টাকা ছিনিয়ে নেয়ার পর যাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে, তাদের কেউই চুরির সাথে জড়িত নন।
আলমডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ আতিয়ার রহমান বলেন, গরু চুরির ঘটনায় ভোদুয়া গ্রামের আমজাদ হোসেন বাদী হয়ে ওই ৬ জনসহ ৮ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। গ্রেফতার ব্যক্তিদের কাছ থেকে জব্দ করা গরু দুটির মালিক আমজাদ হোসেন ও রেজাউল হককে দেয়া হয়েছে। সেই সাথে ট্রাকের গদির নিচ থেকে ১ লাখ ৭৩ হাজার টাকা পাওয়া গেছে।
বিকেলে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ছিনিয়ে নেয়া টাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গ্রামবাসীদেরকে টাকা ফেরত দিতে নির্দেশ দিয়েছে। ছিনিয়ে নেয়া প্রায় ৪ লাখ টাকা উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ ভোদুয়া গ্রামের বাংলা মেম্বার ও চুরি যাওয়া গরু মালিক একই গ্রামের আমজাদ হোসেনকে আটক করে।