স্টাফ রিপের্টার: মংলা বন্দর দিয়ে গত ৬ বছরে নিয়মনীতি ভঙ্গ করে আমদানি করা হয়েছে ২ হাজার ৭৯টি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি। এ মুহূর্তে নির্ধারিত অবচয় বাদ দিয়ে গাড়িগুলো খালাস করা সম্ভব হলে সরকারের রাজস্ব আয় হবে ১৫১ কোটি টাকা। কিন্তু নীতিবহির্ভূতভাবে আমদানি করায় শুল্কায়ন জটিলতা দেখা দিলে গাড়িগুলো খালাস দেয়া যায়নি। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে বন্দরেই আটকা থেকে নষ্ট হচ্ছে এসব গাড়ি। এসব গাড়ি ছাড় করতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক হয় কয়েক দফা। কিন্তু বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে আনা হয়। এরপর এ বিষয়ে সম্প্রতি চারটি নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রীর দেয়া প্রথম নির্দেশেই গাড়িগুলোর শুল্কের বিষয় কী হবে তা নির্র্ধারণ করতে বলা হয়। পাশাপাশি প্রকৃত আমদানিকারক গাড়িগুলো নেবে কি-না বা কিভাবে আইন অনুযায়ী বাজেয়াপ্ত করা যায়- এ বিষয়গুলো স্পষ্ট করতে বলা হয়। এছাড়া যা করলে গাড়িগুলো বন্দর থেকে বের করে জায়গা খালি করা যায় তার ব্যবস্থা করতেও তিনি নির্দেশ দেন। নির্দেশে আরও বলা হয়, এসব নির্দেশনার মধ্যে যা বাস্তবায়নযোগ্য তা গ্রহণ করতে হবে।
জানা গেছে, ২৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ নির্দেশের একটি কপি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ও নৌপরিবহন সচিবের কাছে পাঠানো হয়েছে। এ সম্পর্কিত চিঠিতে বলা হয়, মংলা বন্দরে দীর্ঘদিন ধরে অখালাসকৃত গাড়ির বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের সভাপতিত্বে ৭ অক্টোবর একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। ওই সভার কার্যবিবরণী প্রধানমন্ত্রীর অবগতি, অনুমোদন ও নির্দেশনার জন্য উপস্থাপন করা হলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখিত নির্দেশনা দেন।
ড. মসিউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকের কার্যবিবরণী সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এসব গাড়ি আমদানি করা হয়। এর মধ্যে আমদানিনীতি ভঙ্গ করে কয়েকজন আমদানিকারক ৫ বছরের বেশি পুরনো ৫১২টি গাড়ি আমদানি করে। এছাড়া আরও ১ হাজার ৫৬৭টি গাড়ি বন্দরে খালাস বন্ধ রাখা হয়েছে নিয়মনীতি ভঙ্গের কারণে। কার্যবিবরণীতে বলা হয়, ২০১১-১২ অর্থবছরের হিসাবে প্রতিটি গাড়ির শুল্ককরের পরিমাণ গড়ে সোয়া ৯ লাখ টাকা এবং চলতি অর্থবছরের হিসাবে ৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। যদি গড়ে প্রতিটি গাড়ির গড় অবচয় ৪৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয় তাহলে মোট ১৪০ কোটি টাকা বাদ দিতে হবে। আর এতে শুল্কায়ন পরবর্তী রাজস্ব হিসাবে আয় হবে ১৫১ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যাল অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সাবেক প্রেসিডেন্ট ও এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক মো. হাবিবুল্লাহ ডন গতকাল শুক্রবার বলেন, আটকে থাকা গাড়িগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে গত সপ্তাহে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। সেখানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিভাগীয় কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তিনটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে আমদানিনীতি ভঙ্গ করে আনা ৫১২টি গাড়ি নিলামে দেয়া হবে। বাকি ১ হাজার ৫৭৬টি গাড়ির মধ্যে শুল্কায়ন জটিলতায় আটকে থাকা এক হাজার গাড়িকে সর্বোচ্চ অবচয় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সুবিধা দেয়া হবে আমদানিকারকদের। বাকি ৫০০ গাড়ি আটক করা হয় আট মাসে। এর মধ্যে কিছু গাড়ি শুল্ক দিয়ে ব্যবসায়ীরা বের করে নিয়েছে। বাকিগুলোও বের করে নেয়া হবে।
বর্তমানে পুরনো গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা অবচয় সুবিধা পাচ্ছে সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ। কিন্তু উল্লিখিত গাড়িগুলো দীর্ঘদিন খালাস না হওয়ায় আমদানিকারকরা লোকসানের মুখে পড়ায় সর্বোচ্চ অবচয় সুবিধা দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ সব ধরনের চার্জের ৫০ শতাংশ মওকুফ করবে।
৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টার সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে এসব গাড়ি পুলিশ বিভাগকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো। ওই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোজ্জামেল হক খান বলেছেন, আটকে থাকা গাড়িগুলোর মধ্যে শুধু ব্যবহার যোগ্যগুলো গ্রহণ করা হবে। তবে ব্যবহার অনুপযোগী গাড়ি নিতে পুলিশ বিভাগ রাজি হয়নি। তিনি আরও বলেন, গাড়িগুলোর যান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পুলিশের নিজস্ব দক্ষ কারিগরি দল নিয়োগ করাসহ প্রযুক্তির অবস্থা নিরপেক্ষ নিরূপণের জন্য বিআরটিএর সহযোগিতা নেয়া হবে। এছাড়া বন্দর থেকে গাড়ি বের করা, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন পরিস্থিতি ও স্থানীয় শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতানৈক্য দূর করতে স্থানীয় পর্যায়ে বিভাগীয় কমিশনারকে দায়িত্ব দিয়ে তাকে সহযোগিতার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একই পদমর্যাদা কর্মকর্তা নিযুক্ত করার কথা বলা হয়।
এছাড়া ওই বৈঠকে আগামী ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে গাড়িগুলো খালাস করার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে কাজগুলো শেষ করতে না পারলে বিভাগীয় কমিশনারসহ ত্রিপক্ষীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সময় বাড়ানোর সুপারিশের কথা বলা হয়। গাড়িগুলো বন্দর থেকে বের করে পুলিশের তত্ত্বাবধায়নে রাখারও সিদ্ধান্ত হয়। এক্ষেত্রে উপযুক্ত শুল্ক কর্মকর্তা পুলিশ পাহারায় কর্মরত দলের সাথে থাকবেন। এছাড়া রিজার্ভ ভ্যালু নির্ধারণের ক্ষেত্রে কাস্টমস, পুলিশ ও বিআরটিএ যৌথভাবে কাজ করবে।
বারভিডার এক নেতা জানান, আনুমানিক ২০ থেকে ২৫ দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টার এক নির্দেশে নামমাত্র মূল্যে গাড়িগুলো পুলিশ বিভাগকে দেয়ার কথা বলা হয়। যা অন্য কোনো দেশে করা হয়েছে বলে নজির নেই। আমাদের আমদানি করা পণ্য অন্যকে দেয়া হচ্ছে অথচ আমরা জানি না। তিনি আরও বলেন, এসব বিষয় আমরা অর্থমন্ত্রীর সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তুলে ধরেছি। অর্থমন্ত্রী আমাদের বলেছেন, গাড়িগুলো দীর্ঘদিন বন্দরে আটকে আছে। এ বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীও বিরক্ত। যে কোনোভাবে গাড়ি খালাস করে বন্দরের জায়গা ফাঁকা করার কথা বলা হয়। তিনি বলেন, এনবিআর থেকে পরবর্তী নির্দেশ দেয়া হলে ব্যবসায়ীরা গাড়িগুলো ছাড় করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।