অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো নিয়ে মন্ত্রিসভায় আলোচনা : বঞ্চিতরা পদোন্নতি পাচ্ছেন

স্টাফ রিপোর্টার: নতুন বছরের শুরুতেই ২টি বড় চমক পেতে পারেন সরকারি চাকরিজীবীরা। এর একটি অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি আর অপরটি পদোন্নতি বিষয়ক। প্রশাসনে ইতোমধ্যে পদোন্নতির তোড়জোড় চলছে। উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব এবং অতিরিক্ত সচিব- এই তিন স্তরের পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তার পদোন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। গত ২৫ নভেম্বর অন্যান্য ক্যাডার থেকে যারা প্রশাসন ক্যাডারে আত্মীকৃত হতে চান তাদের আবেদন নেয়াও শেষ হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারের পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় ইতঃপূর্বে বঞ্চিতরাই প্রাধান্য পাবেন। আর তা হলে এটি চমকই হবে, কারণ বঞ্চিতদের খুঁজে বের করে পদোন্নতি দেয়াটা ব্যতিক্রমধর্মী কাজ। অপরদিকে চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা আবারও বাড়ানো হচ্ছে এমন খবরও বেশ জোরদার। এটি এখন সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত সভায় মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তার বয়স ৬৫ করার প্রস্তাব নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে। সেখানে ৬৫ বছর পর্যন্ত অবসরেরর বয়স নির্ধারণ করা হলে সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া নিয়ে কথা হয়।
প্রসঙ্গত, ১৯৮২ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যেসব ব্যক্তি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন সেসব ব্যাচের অন্তত হাজার খানেক কর্মকর্তা রয়েছেন যারা বিভিন্ন ধাপে (উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব) পদোন্নতি পাননি। এবার তাদেরকেই বিশেষ সুযোগ দিতে পদোন্নতির প্রক্রিয়াটি শুরু করা হয়েছে। পাশাপাশি ১১তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নতুন করে উপ-সচিব পদে পদোন্নতির তালিকায় নেয়া হচ্ছে। যদিও প্রশাসনে কোনো শূন্য পদ নেই। বরং প্রতিটি পদের বিপরীতে অসংখ্য কর্মকর্তার উপস্থিতি প্রশাসনকে ভারী করে তুলেছে।
বিদ্যমান পদ ও কর্মকর্তার সংখ্যা: সর্বশেষ চলতি বছরের ৬ এপ্রিল তিন স্তরে বড় আকারের পদোন্নতি দেয়া হয়। এ সময় অতিরিক্ত সচিব পদে ২৩১ জন, যুগ্ম-সচিব পদে ২৯৯ জন এবং উপ-সচিব পদে ৩৪২ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। ফলে বর্তমানে মঞ্জুরিকৃত পদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সচিবের ১০৭ পদে ৩৭৩ কর্মকর্তা, যুগ্ম-সচিবের ৪৩০ পদে ৮৬৯ জন এবং উপ-সচিবের ৮৩০ পদে ১,৮১৮ কর্মকর্তা নিয়োজিত আছেন। অবশ্য পরিস্থিতি সামাল দিতে পদোন্নতিপ্রাপ্তদের অধিকাংশকে পদোন্নতি-পূর্ব পদে থেকেই কাজ করতে হচ্ছে। অর্থাত অতিরিক্ত সচিব করছেন যুগ্ম-সচিবের কাজ, যুগ্ম-সচিব করছেন উপ-সচিবের কাজ, উপ-সচিব করছেন জ্যেষ্ঠ সরকারি সচিবের কাজ। অনেকের আবার মঞ্জুরিকৃত পদ জোটেনি। সুপারনিউম্যারারি (সংখ্যাতিরিক্ত) পদে থেকে বিড়ম্বনার মধ্যেই আছেন তারা। তবু পদোন্নতি পাওয়াটাকে গৌরবের বলেই মনে করেন তারা।
বঞ্চনার কারণ: ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে একাধিকবার পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। আর এ প্রক্রিয়ায় বঞ্চনার ঘটনাও ঘটেছে অতীত সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায়। বিপরীত চেতনার চিহ্নিত করার পাশাপাশি কাকে টপকাতে পারলে কার পদোন্নতি নিশ্চিত হবে সে বিবেচনা মাথায় রেখেই পদোন্নতি হয়েছে। আর এতেই ‘কপাল পুড়েছে’ অনেকের। সুশাসনের কথা বলে ‘দলীয় আর নীতিনির্ধারকদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের’ নিরিখে দেয়া পদোন্নতিতে বঞ্চিত থাকতে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই। ৯০ দশকের পর থেকেই প্রশাসনকে এই নোংরা খেলা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী অবশ্য একাধিকবার বলেছেন, পদোন্নতি না হওয়ার পিছনে কোনো রাজনৈতিক কারণ নেই। প্রযোজ্য নম্বর না থাকা, বিভাগীয় বা দুর্নীতির মামলা, শাস্তিপ্রাপ্ত হওয়া, বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে বিরূপ মন্তব্য ইত্যাদি কারণে পদোন্নতি দেয়া সম্ভব হয় না, কিন্তু যারা পদোন্নতি পান না- তারা কেবলই বলেন বঞ্চনার কথা। কারণ নিজেরা জানলেও তারা তা বলেন না। আর সরকারও সামাজিক ও পারিবারিক মর্যাদার কথা ভেবে সব তথ্য প্রকাশ করে না।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র অবশ্য জানিয়েছে, বেশিরভাগ কর্মকর্তার পদোন্নতি সুনির্দিষ্ট কারণে আটকানো হলেও কিছু কর্মকর্তার পদোন্নতি দলীয় বিবেচনায় দেয়া হয়েছে-এটা ঠিক। তবে তার সংখ্যা বেশি হবে না। আবার ব্যাচ ভিত্তিক ঠেলাঠেলির প্রতিযোগিতায়ও অনেকে আটকা পড়েছেন।
নতুন করে পদোন্নতি দেয়া হলে প্রশাসনের চেহারাটা কেমন হবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এখনতো অতিরিক্ত সচিব যুগ্ম-সচিবের পদে কাজ করছেন, এবার পদোন্নতি হলে উপ-সচিবের পদেও তাদের কাজ করতে হবে। আর শাখা কর্মকর্তা বলতে পদের চিহ্নও থাকবে না। মাঠ প্রশাসনে এডিসিরা উপ-সচিব হয়েও সেখানেই থাকবেন। ডিসিরাও যুগ্ম-সচিব হয়ে থাকবেন। নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে।
তবে সরকারের নীতি নির্ধারকদের মত ভিন্ন। তাদের কথা বড় ধরনের বিশৃংখলা এড়িয়ে যেসব কর্মকর্তা ন্যায্য পদোন্নতির যোগ্য, তাদেরকে পদোন্নতি না দেয়াটা হবে অন্যায়। প্রশাসন থেকে এ ধরনের অন্যায় দূর হওয়া প্রয়োজন। তাতে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে পদোন্নতির নিশ্চয়তা যেমন ফিরবে আবার কাজেও গতিশীলতা আসবে।
অবসরের বয়সসীমা: গণকর্মচারী অবসর আইন সংশোধন করে আবারও সরকারি চাকরিজীবীদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। এটি জোরদার হচ্ছে মূলত মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের অবসরের বয়স ৬৫ বছর করা সংক্রান্ত প্রস্তাবটি মন্ত্রিসভায় উত্থাপনে উচ্চ আদালতের নির্দেশকে কেন্দ্র করে। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়স ৬০ আর সাধারণ ক্ষেত্রে ৫৯ বছর। খবর রয়েছে, সাধারণ ক্ষেত্রে ৬১ আর মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স ৬২ বছর করার বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে।