ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: ঝিনাইদহের কামান্না দিবস আজ। জেলার শৈলকুপা উপজেলা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্বে কুমারনদের পাড়ে কামান্না গ্রামে ১৯৭১ সালের এই দিনে শহীদ হন ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে শহীদদের গণকবর। পুনর্বাসন করা হয়নি শহীদ পরিবারগুলোকে। মিলাদ মাহফিলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে এ দিবসটি।
জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যার পরপরই মুজিব বাহিনীর ৪২ তরুণ শৈলকুপাকে হানাদার মুক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে কামান্না গ্রামে আসে। তাদের অধিকাংশের বাড়ি পার্শ্ববর্তী মাগুরা জেলার হাজিপুর এবং বাকিদের বাড়ি শৈলকুপায়। হাজিপুরের আবু বকর ও শৈলকুপার মালিথিয়া গ্রামের আলমগীর ছিলো এদের দলনেতা। কামান্না ছিলো শত্রুমুক্ত এলাকা। তাই ৩২ মুক্তিযোদ্ধা রাতে গ্রামটির মাধব চন্দ্র ভৌমিকের বাড়ির একটি টিনের ঘরে এবং ১০ জন গ্রামটির সামেনা বেগমের খড়ের দুটি ঘরে অবস্থান নেন।
এদিকে রাতের আঁধারে স্থানীয় রাজাকার-আলবদর-আল শামসদের গোপন তৎপরতায় দ্রুত সংবাদ পৌঁছে যায় ঝিনাইদহ, শৈলকুপা ও মাগুরার পাক আর্মি ক্যাম্পে। তারা ওই রাতেই চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধাদের এই অস্থায়ী আস্তানা। শৈলকুপার ধলহরাচন্দ্র ও আবাইপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি প্রধান ঘাঁটি ছিলো। দুটি ঘাঁটি থেকেই বিপদ সংকেত জানিয়ে কামান্নায় সতর্ক বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু সতর্কবাণী পৌঁছার আগেই ঘটে যায় ইতিহাসের নারকীয় এই হত্যাকাণ্ড। ওই দিন ভোর রাতে চারপাশ ঘিরে ফেলে গর্জে ওঠে হানাদারদের রাইফেল-স্টেনগান, এসএলআরসহ অত্যাধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র। টিনের বেড়া ভেদ করে ছুটে আসতে থাকে গুলি। হঠাৎ আক্রমণে ক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধারা ঘুম ভেঙে হতবিহ্বল ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। তারপরেও তারা শক্ত হাতে তুলে নেন অস্ত্র। শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে না পারায় তারা পিছু হটতে বাধ্য হন। যে যে ভাবে পারে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। ফলে কেউবা ঘরের মধ্যে, কেউবা ঘরের বারান্দায় আবার কেউ উঠানে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ে। এ যুদ্ধে ২৭ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। রাত গড়িয়ে ভোর হয়, দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। ঘরের ছাদে, মেঝেতে, উঠানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ২৭টি লাশ জড়ো করা হয়। হাজার হাজার মানুষের চোখের জলে ঘটনাস্থল কামান্না হাইস্কুলের পাশেই বয়ে যাওয়া কুমার নদের পাড়ে ৫টি গণকবরে ২৭ মুক্তিযোদ্ধাকে সমাহিত করা হয়। তাদের সাথে ওই রাতে আরও দু গ্রামবাসী শহীদ হন। তারা হলেন, রঙ্গ বিবি ও মুক্তিযোদ্ধাদের পথপ্রদর্শক ফনি ভূষণ কুণ্ডু। ওই দিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ বিশ্ব মিডিয়ায় কামান্না যুদ্ধের ঘটনা গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হয়।
এলাকাবাসী জানান, স্বাধীনতা লাভের পরপরই গঠিত হয় ‘কামান্না ২৭ শহীদ স্মৃতি সংঘ’। দেশ স্বাধীনের মাত্র ১৯ দিন আগে শহীদ হওয়া ২৭ শহীদের রক্তস্নাত পবিত্র স্থানটি সংরক্ষণ বা স্মরণ করে রাখার মতো কিছুই নির্মিত হয়নি আজও। তবে ২০০৮ সালে গণকবরগুলো ঘেষে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করেছে গ্রামবাসী। পরে তারা ২৭ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধিস্থলে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি জানান।
ঝিনাইদহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমাণ্ডার মকবুল হোসেন জানান, এই অবহেলিত শহীদ পরিবারগুলো খুঁজে তাদের পূনর্বাসনসহ তারা যাতে স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করতে পারে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স তৈরি করা হবে। বাংলার দামাল ছেলেরা অকুতোভয় সাহস নিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধে সে দিন ঝাপিয়ে পড়ে নিজের জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করে গেছে। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও আজও তাদের কবরস্থান উপেক্ষিত। তাই এ সরকারের কাছে অচিরেই ২৭ শহীদের গণকবর সংরক্ষণ ও তাদের পরিবারগুলোর পুনর্বাসন করার দাবি এলাকাবাসীর।
ঝিনাইদহের কামান্না দিবস আজ
