আজ থেকে তিন বছর আগে, আজকের এই দিনটি শুরু হয় দুঃসংবাদ শুনে। যে দুঃসংবাদের বেদনা, কষ্ট, শূন্যতা বয়ে বেড়াচ্ছে মাথাভাঙ্গা পরিবার। অবশ্য সশরীরি উপস্থিত না থাকলেও প্রধান সম্পাদক হিসেবে মাথাভাঙ্গা পরিবারের অন্তরের হাজিরা খাতায় অনুপস্থিত নন একদিনও। তিনি সাইফুল ইসলাম পিনু। শুধু কি মাথাভাঙ্গা পরিবার? তাকে আজ স্মরণ করছে এলাকার অধিকাংশ মহল। যে মানুষটি মানবতার কথা বলতেন, ন্যায় প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে যার ছিলো সরব উপস্থিতি তিনি মাঠে ময়দানে অশরীরি হলেও তার আদর্শই তো আমাদের তথা সত্য প্রকাশে সংগ্রামীদের প্রেরণা!
১৯৯১ সাল। চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের আঙিনায় তুখোড় চার আড্ডাবাজের আকাঙ্ক্ষারই ফসল মাথাভাঙ্গা। আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের আগে সরদার আল আমিনেরই প্রকশানায় প্রস্তাবিত সংখ্যায় সম্পাদক ছিলেন হামিদুল হক মুন্সি। ছাড়পত্র পাওয়ার পূর্বেই প্রশাসনিক আপত্তির প্রেক্ষিতে মাথাভাঙ্গা পরিবার পেয়ে যায় সাইফুল ইসলাম পিনুকে। একই বছরের ১০ জুন কুসংস্কারের অন্ধকার দূর করা, দুর্নীতি অনিয়মের আখড়া ভাঙা আর ন্যায় প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ শুরু হয় একদল কলম সৈনিকের। চলছে। চলবে। চলার মাঝে, হাঁটার পথে কতোইনা স্মৃতি, কতোইনা ইতিহাস। সহযোদ্ধারা সকলেই নক্ষত্র। ন্যায় প্রতিষ্ঠার সৈনিক। এদের কারো কারো চিরপ্রস্থানে সহযোদ্ধাদের শোকে কাতর হলে কি চলে? চলে গেছেন অনেকে। সাইফুল ইসলাম পিনু, পিনুপত্মি নাজমা আরা বেগম মমতাজ, সদরুল নিপুল, হাফিজ মাস্টার, সাঈদুল্লাহ আল সাহেদসহ বহু সহযোদ্ধাকে হারাতে হয়েছে। হারানো মানেই অপূরণীয় শূন্যতা। যদিও মাথাভাঙ্গা পরিবার তা বিশ্বাস করে না বলেই প্রেরণা হিসেবে পাশে রেখেছে সকলকে। আজকের এই বেদনার দিনে হারানো সকলের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা।
সাইফুল ইসলাম পিনু শুধু সম্পাদক, সাংবাদিকই ছিলেন না, তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধিও ছিলেন। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে পর পর দুবার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রজীবনেও তিনি ছিলেন তুখোড় নেতা। চুয়াডাঙ্গা কলেজটি সরকারিকরণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কনভয়ের সামনে দাঁড়িয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তখনকার ভিপি পিনু। শ্রেণিশত্রু আখ্যা দিয়ে খতমের অপর নাম রক্ত নিয়ে হোলিখেলা। সভ্যসমাজে এসব হতে পারে না। এ বক্তব্য দিয়ে মাথাভাঙ্গা পরিবারকে সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালনে সহায়ক করেছেন তিনি। সাহস জুগিয়েছেন সর্বক্ষেত্রে। তিনি ভালো মানুষ ছিলেন। শুধু এটুকু বলা মানে তাকে সত্যিই খাটো করা। কতোটা ভালো মানুষ ছিলেন তিনি তা বর্ণনা করাও সত্যিই কঠিন। সেরার মাঝে সেরা ছিলেন, ভালোদের মাঝে ছিলেন চমৎকার। তিনিই বলতেন, ‘সত্য প্রকাশে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো নৈতিক দায়িত্ব। ভয়? মানি না। যদি করতেই হয়, তা হলে যারা প্রেরণা, অবিরাম সাহস, তাদের তথা পাঠককূলকেই ভালোবাসামাখা শ্রদ্ধার ভয় করি আমরা।’
আমিত্ব নয়, কর্তৃত্ব নয়। সর্বক্ষেত্রে দায়িত্বপালনে নিষ্ঠাবান হয়ে অন্যের প্রতি কতোটা আন্তরিক হতে হয় তা সাইফুল ইসলাম পিনুর কর্মময় জীবন বিশ্লেষণ করলে আঁচ পাওয়া যায়। অন্যের উপকারে? তিনি ছিলেন উদাহরণ। বাস্তবকে হাসিমুখে মেনে নেয়া, সময়ের অপচয় না করে যতোটা সম্ভব কাজে লাগানোর তাগিদ ছিলো তাঁর। যদিও পরোপকারিতা তাকে মানসিকভাবে ধনী করলেও আর্থিকভাবে ছিলেন পিছিয়ে। তবুও সর্বদা মুখে থাকতো বিজয়ের হাসি। প্রতিপক্ষের হিংসাও হাসতে হাসতে মেনে নিয়ে বলতেন ‘তোমার চোখ টাটানিই আমার সফলতার সোপান।’ তাঁকে ভালো রেখো স্রষ্টা।