স্টাফ রিপোর্টার: দলীয়ভাবে অনুষ্ঠেয় পৌরসভা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়ে নির্বাচন বিধিমালার খসড়া চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার শর্ত শিথিল রাখা হয়েছে। মেয়ররা অনূর্ধ্ব ২০০ জন ও কাউন্সিলররা ৩০ জন ভোটারের স্বাক্ষর সংবলিত তালিকা জমা দিয়েই স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন। বিগত দিনে পৌর মেয়র বা কাউন্সিলর ছিলেন এমন ব্যক্তিরা কোনো স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা জমা দেয়া ছাড়াই প্রার্থী হতে পারবেন। এ নির্বাচনে প্রতি পৌরসভায় সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা ব্যয় করতে পারবে রাজনৈতিক দলগুলো। চেকের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা অনুদান নেয়া যাবে। ইসির সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচন বিধিমালা ও প্রার্থীদের আচরণবিধির খসড়া চূড়ান্ত করেছে ইসি। দলীয়ভাবে প্রথমবারের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজন করায় বিধিমালা দুটিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। সময় কম থাকায় বিধিমালা সংশোধনে রাজনৈতিক দল বা সুশীল সমাজের সঙ্গে কোনো ধরনের সংলাপে বসেনি কমিশন। আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিধিমালা তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া বিধিমালা চূড়ান্ত করতে নোটিশ দিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো কমিশন সভা ডাকা হয়নি। অনানুষ্ঠানিকভাবে দফায় দফায় বৈঠক করে এটি চূড়ান্ত করা হয়।
আগামী ২০-২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে ২৪৫ পৌরসভায় নির্বাচন করার পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। এ তথ্য জানিয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাবেদ আলী বুধবার বলেছেন, ডিসেম্বরের প্রথম দিকে স্কুলের শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হবে। জানুয়ারিতে ভোটার তালিকা প্রকাশ করা নিয়ে আমাদের কর্মকর্তারা মাঠে ব্যস্ত থাকবেন। এছাড়া জানুয়ারিতে শুরু হবে বিশ্ব ইজতেমা। ফেব্র“য়ারিতে এসএসসি পরীক্ষা। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, ২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে ভোটগ্রহণ করতে পারলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ভালো হবে। তিনি আরও বলেন, আচরণ বিধিমালা মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হবে। সেখান থেকে এলে কমিশন নির্বাচনের চূড়ান্ত দিনক্ষণ ঠিক করবে। বিধি সংশোধনে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করা হবে কিনা বা তাদের কাছ থেকে মতামত জানতে চাওয়া হবে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিতে পারলে ভালো হতো। তবে তা সম্ভব হয়নি। তবে বিধিমালায় এমন কিছু রাখা হয়নি, যাতে রাজনৈতিক দলগুলো ভিন্নমত প্রকাশ করবে।
বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার সুযোগ বন্ধ : পৌরসভা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকছে না। শুধু দলীয়ভাবে মনোনীত অথবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে নির্বাচনী বিধিমালায়। এতে দল প্রাথমিকভাবে একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে পারবে। সে অনুযায়ী ওই ব্যক্তিরা মনোনয়নপত্র দাখিল করতে পারবেন। তবে দল একজনকে প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়ার পর বাকিদের প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যাবে। তাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও নির্বাচন করার সুযোগ থাকবে না। এ বিষয়ে প্রস্তাবিত বিধিমালার ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দল নির্বাচনী এলাকার কোনো পদে প্রাথমিকভাবে একাধিক ব্যক্তিকে মনোনয়ন প্রদান করলে, উক্ত রাজনৈতিক দলের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক বা সমপর্যায়ের পদাধিকারাী বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কার্যনির্বাহকের স্বাক্ষরিত লিখিত পত্রের মাধ্যমে তিনি নিজে বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বা তার পূর্বে চূড়ান্ত প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়ে রিটার্নিং অফিসারকে অবহিত করবেন এবং সেই ক্ষেত্রে উক্ত দলের মেয়র বা সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর বা সাধারণ কাউন্সিলর পদের অন্যান্য মনোনীত প্রার্থী আর প্রার্থী হিসেবে গণ্য হবেন না। প্রস্তাবিত বিধিমালায় প্রার্থী চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়ার পর কোনো অবস্থায় তা প্রত্যাহারের বা বাতিল করা যাবে না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। ইসির কর্মকর্তারা জানান, এর মাধ্যমে মূলত দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের ঠেকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারা আরও জানান, সাধারণত দলীয় নির্বাচনে দলের প্রাথমিক মনোনয়ন নিয়ে একাধিক প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেন। প্রার্থী যাচাই-বাছাই ও প্রত্যাহারের সময়সীমা পার হওয়ার পর দল যাকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেবে একমাত্র তিনিই দলীয় প্রতীক পাবেন। বাকিদের মনোনয়নপত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। ওই সময়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সময় থাকে না।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার জাবেদ আলী বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের মতোই এটি রাখা হয়েছে। দল যাকে মনোনয়ন দেবে তিনিই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে চাইলে তাকে আগেই স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে।
আচরণ বিধিমালায় দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, চিফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা, বিরোধীদলীয় উপনেতা, প্রতিমন্ত্রী, হুইপ, উপমন্ত্রী বা তাদের সমমর্যাদার কোনো ব্যক্তি, সংসদ সদস্য ও সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়ার বিষয়ে কিছু বিধিনিষেধ রাখা হয়েছে। তারা ভোটগ্রহণের দিন ভোট দেয়া ছাড়া ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ বা ভোটগণনার সময়ে গণনা কক্ষে প্রবেশ বা উপস্থিত থাকতে পারবেন না।
মনোনয়নের ক্ষমতা পাচ্ছেন ক্ষমতাপ্রাপ্ত নেতারাও : পৌরসভা নির্বাচনে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও ক্ষমতাপ্রাপ্ত নেতাদের মনোনয়ন দেয়ার এখতিয়ার দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে নির্বাচন বিধিমালায় বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলের পক্ষে সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক বা সমপর্যায়ের পদাধিকারী বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কার্যনির্বাহকের স্বাক্ষরিত এ মর্মে প্রত্যয়ন থাকতে হবে যে, প্রার্থীকে ওই দল থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক দল মেয়র, সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর ও সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে প্রাথমিকভাবে একাধিক মনোনয়নপত্র প্রদান করতে পারবে। রাজনৈতিক দল ক্ষমতাপ্রাপ্ত কার্যযনির্বাহকের নাম, পদবি ও নমুনা স্বাক্ষরসহ একটি চিঠি তফসিল ঘোষণার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে প্রেরণ করবে এবং তার অনুলিপি নির্বাচন কমিশনেও দাখিল করতে হবে।
নির্বাচিতদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে ভোটার স্বাক্ষর লাগবে না : স্বতন্ত্রদের প্রার্থী হওয়ার শর্ত সহজ করা হয়েছে। ৫০ হাজারের বেশি ভোটার সংবলিত পৌরসভার নির্বাচনে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থীর ২০০ জন ও ৫০ হাজারের কম নির্বাচনী এলাকার ক্ষেত্রে ১০০ জন ভোটারের স্বাক্ষর সংবলিত তালিকা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে হবে। সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীদের ক্ষেত্রে জমা দিতে হবে ৩০ জনের স্বাক্ষর। তবে বিগত দিনে মেয়র বা কাউন্সিলর নির্বাচিতদের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হবে না। একজন নির্বাচন কমিশনার জানান, নির্বাচনে বিরোধী জোট নির্বাচন বয়কট করলেও প্রার্থী সংখ্যা যাতে বেশি হয় সেই বিবেচনায় এ বিধান করা হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের শতকরা ১ ভাগ ভোটারের স্বাক্ষর সংবলিত তালিকা জমা দেয়ার বিধান রয়েছে।
প্রার্থীর মৃত্যু হলে নির্বাচন বন্ধ : পৌরসভা নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর মৃত্যু হলে সেখানে নির্বাচন বন্ধের বিধান রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বৈধভাবে মনোনীত মেয়র প্রার্থীর কেউ মৃত্যুবরণ করলে রিটার্নিং কর্মকর্তা ওই পৌরসভার এবং কাউন্সিলর মারা গেলে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের নির্বাচনের সব কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করবেন।