বিস্মৃতপ্রায় লালনের অন্যতম সাধনসঙ্গিনী ছত্রপাড়ার কামিনী ফকিরানী
রহমান মুকুল: লালনের শিষ্য-প্রশিষ্যদের সম্পর্কে সন্তোষজনক তথ্য পাওয়া গেলেও মোটেও সম্ভব হচ্ছে না তার সাধনসঙ্গিনীদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানা। অথচ লালনের কামিয়াব হওয়ার পেছনে সাধনসঙ্গিনীর অবদান সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ। লালনের একমাত্র সাধনসঙ্গিনী বিশাখার নাম জানা গেলেও তার সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
বাউল সাধনার মূলকথা গোপনীয়তা। এ বাউল সম্প্রদায় অসম্প্রদায়ীদের কাছে হয় কিছু বলতে চায় না, যদি কিছু বলে থাকে তবে সেটাও আসল ভেদকথা নয়। বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশে কিছু বলে দেয়া। তারা এ বিভ্রান্তি ছড়ানোকে আত্ম-সাবধান বলে থাকে। ‘আত্ম-সাবধানের মূল বক্তব্য হলো- আপন সাধন-কথা/না কহিও যথাতথা/আপনারে আপনি তুমি হইও সাবধান।‘ এমন ‘সহজ মানুষ’ সম্প্রদায়ের নিকট থেকে স্বয়ং লালনের সাধনসঙ্গিনীদের বা সাধিকাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ মোটেও সহজ সাধ্য কাজ নয়। রীতিমতো ধর্না দিয়ে কিছুটা তথ্য সংগ্রহ সম্ভব হয়েছে। লালনের সময়কালে বা তার আগে পরে বাউলরা সব সময় নিজেদের সাধন পদ্ধতির ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা করতো। তাদের আখড়ায় অনেক সাধিকা থাকতো এবং বাইরের মানুষকে তারা নিজেদের জীবনাচরণ বলতো না। উত্তরাধিকারসূত্রে এ ব্যাপারে এখনো তাদের গোপনীয়তা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের।
ফকিরি সাধনায় সাধন-সঙ্গিনী অত্যাবশ্যক। সঙ্গিনীর ভূমিকা প্রায় সমান। কারণ সঙ্গিনী ছাড়া সাধক সম্পূর্ণ নন। তাদের মতে- স্রষ্টা ছিলেন আপনাতে আপনি গুপ্ত। নৈরাকারকে আকারে আনতে তিনি আদমকে সৃষ্টি করলেন। কী ছিলো সেই আকারবিশিষ্ট আদমের মধ্যে? যে কারণে ফেরেশতাকুলকে তিনি আদেশ দিলেন আদমকে সেজদা করতে। সেজদা না দেয়ার অপরাধে আযাযিল ফেরেশতাকে কেন হতে হলো অভিশপ্ত শয়তান ইবলিস? আল্লাহ ছাড়া যে কাউকে সেজদা দেয়া যায় না। আযাযিল তা জানতেন। তা হলে চিরকালের নিরাকার স্রষ্টা আদমকে সেজদা দিতে বলেছিলেন কেন? কী রহস্য লুকিয়ে ছিলো সাকার আদমের ভেতর? কোনো ভেদ বুঝতে না পারায় আযাযিলকে হতে হলো ইবলিস। স্রষ্টার সেই রহস্যময় সত্ত্বাই পূর্ণ মানুষ আদম। নিরাকার স্রষ্টার আকারময় রূপ। তারপর স্রষ্টা আদমকে খণ্ডিত করে হাওয়াকে সৃষ্টি করেন। তাঁদের আনন্দময় মিলনে একাকার হবার মধ্যেই আবার পূর্ণত্ব লাভ করে মানুষ। একাকার মিলনেই সৃষ্টি হয় সন্তান-সন্ততি। এটাই তাদের মতে সৃজন-সাধন।
মিলন সাধন শুধু একাকার হওয়াতে পূর্ণ হয় না। দুয়ে মিলে এক নয়, শূন্য হয়ে যেতে হয়। আকার নিয়ে নিরাকারে প্রবেশ করা যায় না। শূন্যের কোনো আকার নেই। তাই শূন্য হয়েই নিরাকারে বিলীন হতে হয়। দুয়ে মিলে প্রথমে এক আকার ধারণ করা, তারপর নিরাকার থেকে আকার লাভ, সেই নিরাকারে মিশে সবার জন্য পরমানন্দময় শূন্য হয়ে যাওয়া। স্রষ্টা নিজেই পরমানন্দময়-প্রেমানন্দময়। সাধকের প্রেমানন্দ তাই কামসুখ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। বস্তু পতনে কাম, বস্তুকে চেতনলোকে নিয়ে যাওয়াতেই প্রেম। কামসুখ ক্ষণস্থায়ী। প্রেমানন্দ অক্ষয়।
বাউল মানুষ ভজে, যেখানে সাঁই নিত্য বিরাজে। বাউলের কারবার মানুষ, তার স্রষ্টা এবং তার সৃষ্টির অনুসন্ধান। বাউল সত্যের উপাসক। নিজ দেহের পরিমণ্ডলে তার সাধন-ভজন আচার, বিহার। লালন তত্ত্ব হচ্ছে সিনায় সিনায় কারবার। শিষ্য গুরুর তত্ত্ব নেবে সিনা থেকে সিনাতে। তাহলেই তো শিষ্য পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। গুরু বাঁধা পড়বেন শিষ্যের সিনাতে। আধ্যাত্মিকতার চর্চায় মানবদেহকে ঈশ্বরের আবাস (বারামখানা) মনে করে। নারী-পুরুষে মিলন বাউলদের সাধনার সারবস্তু। পুরুষের বীজ আর নারীর রজ. মিলিত হয়ে মানবের জন্ম। যৌন উত্তেজনার চুড়ান্ত পর্যায়ে সহজ মানুষ বা ঈশ্বরের অটলরূপ উপস্থিত হয় বলে এদের বিশ্বাস। বাউলরা এই স্তরে পৌঁছে স্থির থেকে সাধন করতে চায়। কাম নদীর নিম্নমুখি ধারাকে ঊর্ধ্বমুখী করে সহজ মানুষ সাধন করতে পারে যারা তারা হলো সিদ্ধ পুরুষ। তাদের মতে ফকির লালন একজন সিদ্ধপুরুষ। লালন তার গানে বলছেন:
‘আমি কী সন্ধানে যাই সেখানে
মনের মানুষ যেখানে।
আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি
দিবা রাতি নাই সেখানে।
যেতে পথে কাম নদীতে
পারি দিতে ত্রিবিণে (ত্রিবেণী)
কত ধনীর ধারা যাচ্ছে মারা
পইড়ে নদীর তোড় তুফানে।
লালনের সেই মনের মানুষ অর্থাৎ সাধনসঙ্গিনী সম্পর্কে জানতে একদিন পা রাখলাম ছেঁউড়িয়ায় লালন শাহর আখড়ার মূল প্রাঙ্গণে। প্রথমেই নজর কাড়লো তাজমহল সদৃশ্য গম্বুজাকৃতি শুভ্র স্থাপনা। গম্বুজের নিচে পালক মা’র পাশে লালনের সমাধি। এরপর সামনের চত্বরে লালনের সাধনসঙ্গিনী বিশাখা ফকিরানীসহ ৩টি সমাধি। সামনে নিচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা সেই পুণ্য-প্রাঙ্গণের খোলা অংশে লালনের প্রথম ভক্ত শীতল শাহ ফকির, সাঁইজির নিজ হস্তে মুরিদ ছেঁউড়িয়ায় তার আশ্রয়দাতা পালক পিতা মলম শাহ, কুসুম ফকিরানী, কামিনী ফকিরানী, প্যারীনেছা ফকিরানী, ভোলাই শাহ ফকির, মহিম শাহসহ সর্বমোট বারো জনের সমাধি।
স্বয়ং লালনের মাজারে যাদের সমাধি রয়েছে তাদের গুরুত্ব এ সম্প্রদায়ের নিকট বর্ণনাতীত। খোদ লালন শাহ’র বড় ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন তারা। লালনের সাধনসঙ্গিনী বিশাখা ও প্যারীর নাম অনেকেই জানেন। কিন্তু তাদের সম্পর্কে কেউ উল্লেখযোগ্য তথ্য দিতে পারেননি। প্যারী ফকিরানী কুমারখালির চড়াইকোল গ্রামের মৃত শুকুর আলী শাহ’র মেয়ে বলে জানা যায় এবং প্রখ্যাত ভোলাই শাহ’র স্ত্রী। শীতল শাহ বড় ফকির ও ভোলাই শাহ ছোট ফকির হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এরা স্বামী-স্ত্রী উভয়েই লালনের খুব প্রিয়ভাজন ছিলেন। কুসুম ফকিরানী সম্পর্কে অনেক চেষ্টা করেও কিছুই জানা সম্ভবপর হয়নি। তবে তিনিও যে লালনের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তা বোঝা যায় মাজারে অন্যান্য ঘনিষ্ঠদের সাথে তার সমাধি দেখে।
কামিনী ফকিরানীও লালন শাহ’র খুবই ঘনিষ্ঠ ও প্রিয়ভাজন শিষ্য ছিলেন। আলমডাঙ্গার ছত্রপাড়া গ্রামের মান্দার বক্সের স্ত্রী ছিলেন কামিনী ফকিরানী। তারা ছিলেন নিঃসন্তান দম্পতি। কড়িসহ সমস্ত সম্পদ তিনি তার প্রিয় শিষ্য ইজ্জত শাহকে দিয়ে যান। ইজ্জত শাহও নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি সমস্ত সম্পদ তার ভাস্তে ও শিষ্যছেলে শাহাদত শাহকে দিয়ে যান। শাহাদত শাহ’র মৃত্যুর পর সন্তানেরা ওই সম্পদ ভোগ করছেন সাধু ও দরবেশ শাহ। কামিনি ফকিরানীর এখনও অনেক স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়ে গেছে। ছত্রপাড়া গ্রামের কামিনী ফকিরানীর বাড়িতে একাধিকবার লালন শাহ বেড়াতে গিয়েছিলেন বলে এলাকায় বহুল কথিত। এলাকার বাউল-ফকিররা গুরু পরম্পরায় এ কাহিনি জেনে এসেছেন বলে দাবি করেন। ঘোড়ায় চড়ে লালন শাহ যেতেন তার প্রিয় শিষ্যার বাড়িতে। এ নিয়ে কতো ধুন্ধুমার কাহিনি!
বাউল সম্রাট লালন শাহ মাঝে-মধ্যেই হাজির হতেন কামিনী ফকিরানীর বাড়িতে। বিশেষ করে ১৯ ও ২০ অঘ্রাণ প্রতি বছর তিনি কানাই-বলাই নামের ২ শিষ্যকে নিয়ে কামিনী ফকিরানীর সাধুসঙ্গে উপস্থিত হতেন। লালন একাই গানে গানে মাতিয়ে রাখতেন কামিনির সাধুসঙ্গ। পরবর্তীকালে স্বামীর মৃত্যুর পরও অব্যাহত ছিলো লালনসহ বিভিন্ন সাধুদের আসা-যাওয়া। বিষয়টি বিধবা কামিনী ফকিরানীর গ্রামের লোকজন ভাল চোখে দেখতো না। এক পর্যায়ে গ্রামের কতিপয় মণ্ডল ক্ষিপ্ত হয়ে কামিনী ফকিরানীকে একঘরে করে গ্রাম থেকে তুলে দিয়ে তাকে গ্রামের এক পাশ দিয়ে প্রবাহিত কুমার নদের পাড়ে জঙ্গলে ফেলে রেখে যায়। ভেবেছিলো পাপিষ্ঠাকে বন্যপ্রাণিরা খেয়ে ফেলবে। কিন্তু বন্যপ্রাণিরা এ বিদূষীকে খায়নি। এ ঘটনার অনতিবিলম্বে কামিনী ফকিরানীর বিরুদ্ধে গ্রামের যে সকল মণ্ডল ষড়যন্ত্র করেছিলো, তাদের বসত ভিটায় আগুন লেগে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। মণ্ডলরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তার নিকট ক্ষমা চেয়ে পুনরায় কামিনী ফকিরানীকে নিজ ভিটেই বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ক্রমেই কামিনী ফকিরানী পৌঢ় হতে থাকেন। এক পর্যায়ে তার ইচ্ছানুযায়ী গ্রামবাসী তাকে প্রিয় গুরু লালনের ছেউড়িয়ার আখড়া বাড়িতে রেখে আসেন। সেখানেই তার অন্তিম দিনগুলি অতিবাহিত হয়।
বাউল-সাধুদের অনেকের দাবি কামিনী ফকিরানী লালনের সাধনসঙ্গিনীদের অন্যতম। তবে অনেকেই এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাদের দাবি লালনের একমাত্র সাধনসঙ্গিনী ছিলেন বিশাখা। তাছাড়া কামিনী ফকিরানীকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ভালবাসতেনও। কিন্তু সাধনসঙ্গিনী ছিলেন না। কোন মত সঠিক এ বিষয়ে গবেষণা প্রয়োজন। লোকায়ত অনেক ধর্মমত, বাউল বা মরমি বাউলতত্ত্ব নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু লালনের সাধনসঙ্গিনী বা লালনের সাধিকাদের সম্পর্কে বিশেষ তথ্য পাওয়া সম্ভবপর নয়।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: বিশিষ্ট লালন গবেষক নিয়ামত আলী মাস্টার ও বাউল ডাক্তার আতিক।