চিকিৎসায় খরচ বেড়েছে লাগামহীন

স্টাফ রিপোর্টার: দেশে চিকিৎসাসেবার খরচ ভয়ানকভাবে বেড়েছে। সংক্রামক ও অসংক্রামক জটিল রোগ বাড়বার সাথে সাথে প্রতিযোগিতা করে বাড়ছে এসব রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসকের ফি, ওষুধ, পথ্য, অস্ত্রোপচার ও হাসপাতালের শয্যার ভাড়া এবং অন্য খরচ। রোগী ও তাদের পরিবার চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ছেন, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জীবনে নাভিশ্বাস উঠছে। বেসরকারি খাতের ওপর সরকারের নির্ভরতা বাড়তে থাকা, অনেক হাসপাতাল মালিকের সেবার বদলে বাণিজ্যকেন্দ্রিক মানসিকতা, ১৯৮২ সালের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা অধ্যাদেশের কার্যকারিতা না থাকা ও পুরো খাত নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার ফলে ক্রমেই ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে চিকিৎসা। এ অবস্থায় বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবার কথা ভুলে যাচ্ছেন অনেক রোগী।
স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত হলেও এ খাতে সরকারি বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় দিনে দিনে কমছে। সরকারি উন্নত চিকিৎসা ঢাকা কেন্দ্রিক হয়ে ওঠায় দেশের প্রত্যন্ত এলাকার গরিব রোগীদের হাসপাতাল, ওষুধ ও যাতায়াতের খরচ মেটানো অনেক সময়ই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ক্যান্সারের মতো বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও ওষুধ ও সেবার উচ্চমূল্যের কারণে সাধারণ মানুষ তা নিতে পারছেন না। চিকিৎসার খরচ বেশি হওয়ায় প্রতি বছর শতকরা ৪ ভাগ রোগীর পরিবার চিকিৎসা শেষে দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাচ্ছে বলে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। গরিবের নাগালে স্বাস্থ্যসেবাকে রাখার বিবেচনা করে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উদ্যোগ নিলেও গত এক বছরে তা আলোর মুখ দেখেনি।

আবার টাকা দিয়েও অনেক সময় ঠিক চিকিৎসা মিলছে না। অসচ্ছল রোগীরা সরকারি হাসপাতালে এসে যেমন ইউজার ফি’র নামে অতিরিক্ত টাকা দিতে বাধ্য হচ্ছেন, তেমনি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করেও অদক্ষ ও ভুয়া চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় রোগীরা পারছেন না মৃত্যুকে ঠেকাতে। বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাসেবার নামে চলছে প্রতারণা বাণিজ্য। নিম্নমানের চিকিৎসায় প্রাণ ঝরছে রোগীর। অধিকাংশ ঘটনাই থেকে যাচ্ছে আড়ালে, পার পেয়ে যাচ্ছেন অভিযুক্তরা। তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের বাজেটে হেপাটাইটিস-সি ভাইরাসজনিত বা লিভার-সংক্রান্ত জটিল রোগের ওষুধের ওপর উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি এবং আরো বেশ কিছু ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক রেয়াতি সুবিধা দেয়ার পর বিভিন্ন ধরনের ওষুধের দাম কমবার কথা থাকলেও বাজারে এর প্রভাব তেমন নেই। অসাধু বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা অন্য পণ্যের মতো খেয়ালখুশিমতো ওষুধের দাম বাড়াচ্ছেন। জীবন বাঁচাতে ও রোগের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত রোগীরা এসব ওষুধ কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। একই ওষুধের দাম ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন দোকানে ভিন্ন রকম। চিকিৎসার অন্যতম উপকরণ ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেই ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত কয়েকবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম চিকিৎসা খাতে বিত্তবানদের সহযোগিতার আহ্বান জানান। মন্ত্রীর আহ্বানেও তেমন সাড়া মেলেনি। স্বাস্থ্য খাতের বিশাল খরচ কমাতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক সহযোগিতারও দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেন, জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার দরকার। সরকারের একার পক্ষে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কঠিন। স্বাস্থ্য খাতে সবার সহযোগিতা করা উচিত। এটা হচ্ছে জনগণকে সেবা দেয়ার সবচেয়ে বড় খাত। কয়েকজন রোগী ও তাদের স্বজনের সাথে আলাপ করে জানা যায়, চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে তাদের পরিবার। এক বছর ধরে ক্যান্সারের সাথে লড়ছেন ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আসাদুল ইসলাম। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকে ঢাকার জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালে একজন বিশেষজ্ঞের অধীনে তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসকের পরামর্শে এ পর্যন্ত তিনি ১০ বার কেমোথেরাপি নেন। প্রতিবার এর জন্য তার খরচ হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। জমি, গবাদি পশু বেচে ও আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা ঋণ নিয়ে তার চিকিৎসা চলছে বলে জানান তিনি। একই অবস্থা বরিশালের ক্যান্সার আক্রান্ত আয়েশা বেগমেরও। এ পর্যন্ত ১৩টি কোমোথেরাপি নিয়ে তার পরিবারও নিঃস্ব অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। তথ্যমতে, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হেলথ ইকোনমিকস ইউনিট, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জিআইজেড’র যৌথ উদ্যোগে ঢাকায় আয়োজিত এক কর্মশালায় জানানো হয়, চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে বছরে শতকরা ৪ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। এখন এর সংখ্যা আরো বেশি বলে কোনো কোনো স্বাস্থ্য খাত গবেষক মনে করেন। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ’র (আইসিডিডিআরবি) হেলথ ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিনান্সিং রিসার্চ দলের এক জরিপের ফলে বলা হয়, স্বাস্থ্য খরচের ৬৪ শতাংশ ব্যক্তি নিজে বহন করে। ২৬ শতাংশ ব্যয় বহন করে সরকার। বাকি ১০ শতাংশ খরচ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও ব্যবসায়িক বীমা কোম্পানি বহন করে। বিশেষজ্ঞদের হিসাব মতে, স্বাস্থ্য খাতে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বাড়লেও জিডিপির হিসাবে বরাদ্দ কমছে। এতে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। এক যুগ আগেও স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ১ শতাংশ বরাদ্দ ছিলো। বর্তমানে কমে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৭৩ শতাংশ। এক যুগ আগেও এ খাতে বরাদ্দ ছিলো মোট বাজেটের ৬ শতাংশ, যা কমে হয়েছে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। চিকিৎসার সার্বিক খরচের কারণে সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা এখনো সহজপ্রাপ্য নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জনপ্রতি বার্ষিক স্বাস্থ্যসেবা বাবদ প্রয়োজন ৫৪ ডলার। অথচ বাংলাদেশে খরচ হচ্ছে ২৮ ডলার। এর মধ্যে সরকার দিচ্ছে মাত্র ৯ ডলার। বাকিটা যাচ্ছে জনগণের পকেট থেকে। স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদন ঘেটে দেখা যায়, দেশে প্রতিবছর ক্যান্সার, কিডনি, লিভার, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। অসংক্রামক রোগ মোকাবেলায় জাতীয় কোনো দিক নির্দেশনা নেই। কেন্দ্রীয়ভাবেও নেই কোনো ব্যবস্থাপনা। এসব রোগের চিকিৎসার খরচ দেশের অধিকাংশ মানুষের সামর্থ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর অনেক অসংক্রামক রোগের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা দেশে নেই। উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্তরা উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারলেও গরিব রোগীরা দেশে থেকেই মৃত্যুর প্রহর গোনেন।

 

Leave a comment