বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাজা হলে দল ভাঙতে পারে। তাছাড়া শীর্ষ নেতাদেরও সাজা হতে পারে। তখন দলে ঐক্য ধরে রাখাও কঠিন হবে। এ অবস্থায় দলের ঐক্য ধরে রাখতে তুরুপের তাস হিসেবে তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমানের হাতেই দলের হাল তুলে দেয়া হচ্ছে। দলটির ভাঙন ঠেকাতে লন্ডনে বসে এমনই কৌশলী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মা-ছেলে। তাছাড়া দলের শীর্ষ নেতাদের প্রতি অবিশ্বাস থেকেই তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিএনপির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক খ্যাত অধ্যাপক এমাজ উদ্দীন আহমদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ভবিষ্যতের কথা এখন চিন্তা না করাই ভালো। খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য লন্ডন গেছেন। সেখানে তিনি কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিলে তার পুত্রবধূও সঙ্গে যেতেই পারেন। তাছাড়া জোবাইদা দক্ষ চিকিৎসক। তার পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে। তিনি বিএনপির রাজনীতিতে এলে তা তো দোষের নয়। বিষয়টি নিয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে আলোচনা চলছে।
লন্ডনের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, চিকিৎসার ফাঁকে দুই ছেলের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন খালেদা জিয়া। ঈদের আগে বড় ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে দল পুনর্গঠন, পরবর্তী আন্দোলন ও আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা করেন। উভয়ের বিরুদ্ধে বিচারাধীন মামলায় সাজার আশঙ্কাও করেন তারা। অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে দলের হাল ধরবেন কে? গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন মা-ছেলে। তারেক রহমান দেশে ফিরে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে দলের দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু খালেদা জিয়া তাকে বলেন, দেশে আইনের শাসন নেই। এ অবস্থায় দেশে ফিরলে সরকার আটক করে কারাবন্দি করবে। সহসাই জামিন দিবে না। তখন বিএনপিকে ভেঙে মধ্যবর্তী নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করবে। খালেদা জিয়া তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমানকে দেশে ফিরে দলের দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তাব দেন। তারেক রহমান তার স্ত্রীর সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করেন। প্রথমে অনাগ্রহ দেখালেও শেষ পর্যন্ত জোবাইদা রহমান শাশুড়ির প্রস্তাবে রাজি হন। এরপরই সিদ্ধান্ত হয় ঈদের দিন খালেদা জিয়ার সঙ্গে যুক্তরাজ্য বিএনপি ও প্রবাসীদের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন জোবাইদা। বৃহস্পতিবার ইলফোর্ডের ফেয়ারলুপ ওয়ারপার্ক অডিটোরিয়ামের অনুষ্ঠানে শাশুড়ি ও স্বামীর সঙ্গে মঞ্চে বসেন তিনি।
প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি তারেক রহমানের বাসায় অবস্থান করলেও তাকে অনুষ্ঠানে নেয়া হয়নি। এছাড়া চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী., আব্দুল আউয়াল মিন্টুসহ অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও তাদের মঞ্চে বসানো হয়নি। প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দুই শীর্ষ নেতা জোবাইদার রাজনীতিতে অভিষেকের একটি বার্তা দিয়েছেন বলে অনেকে মনে করেন।
জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, দুর্নীতি মামলায় শিগগিরই খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে সাজা দেয়া হতে পারে, এমন ধারণা থেকে পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক করেছেন তারা। দলের ঐক্য ধরে রাখতে তুরুপের তাস হিসেবে মেধাবী চিকিৎসক জোবাইদার রাজনীতিতে দ্রুত অভিষেক ঘটবে। সে ধরনের প্রস্তুতিই নিতে বলা হয়েছে তাকে। জোবাইদা রহমানের ক্লিন ইমেজকে কাজে লাগিয়ে দলের দুঃসময় ও রাজনৈতিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মা ও ছেলে।দলীয় ও পারিবারিক সূত্র জানায়, জোবাইদা রহমান পেশায় ডাক্তার। তিনি প্রয়াত নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার এডমিরাল এম এ খানের মেয়ে। আলোচিত রাজনৈতিক নেতার স্ত্রী হয়েও সব সময় নিজেকে পরিবারের মধ্যেই গুটিয়ে রেখেছেন। একমাত্র মেয়ে জাইমা রহমানকে নিয়ে পর্দার আড়ালেই থেকেছেন সব সময়। এমনকি ক্ষমতার মোহও তাকে স্পর্শ করেনি। ওয়ান-ইলেভেনের সময় নির্যাতনের শিকার হন তার স্বামী তারেক রহমান। ২০০৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর অসুস্থ স্বামী তারেক রহমান চিকিৎসার উদ্দেশে লন্ডন যাওয়ার সময় তিনি কর্মক্ষেত্র থেকে ছুটি নেন। সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী ৫ বছরের বেশি সময় কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার কারণে গত বছরের ১৩ আগস্ট তিনি চাকরিচ্যুত হন। তিনি লন্ডনে অবস্থানকালীন চিকিৎসাবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রিও নিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ওয়ান ইলেভেনের সময় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর ভাঙনের মুখে পড়ে বিএনপি। দলের মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি বড় অংশ সংস্কারের কথা বলে আলাদা বলয় তৈরি করেন। এ সময় খালেদাপন্থি ও সংস্কারপন্থি- এ দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে বিএনপি। খালেদা জিয়া গ্রেফতারের আগে মান্নান ভূঁইয়াকে বহিষ্কার করে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিবের দায়িত্ব দিয়ে যান। জিয়া পরিবারের এই বিশ্বস্ত নেতা হাতেগোনা কয়েকজন নেতাকে নিয়ে বিএনপিকে টিকিয়ে রাখেন। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া শীর্ষ নেতাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। কারণ আন্দোলনে শীর্ষ নেতাদের নিষ্ক্রিয়তা, কয়েকজন নেতার ফাঁস হওয়া ফোনালাপে তাদের ওপর ক্ষুব্ধ খালেদা জিয়া।
এছাড়া ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হান্নান শাহ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, এম কে আনোয়ার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ শীর্ষ নেতারা অসংখ্য মামলার আসামি। এসব মামলায় তাদেরও সাজা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যে কারণে দলের ভাঙন ঠেকাতে পুত্রবধূর ওপরই আস্থা রাখছেন তিনি।বিএনপি নেতাদের মতে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বিতর্ক থাকায় মধ্যবর্তী একটি নির্বাচনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। তবে সে নির্বাচনেও বিজয় সুনিশ্চিত করতে বিএনপিকে বিভক্ত ও শীর্ষ নেতাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার ফন্দি আঁটছেন ক্ষমতাসীনরা।
মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য আগামী বছর সুবিধাজনক সময়কে বেছে নিতে পারে সরকার। তার আগেই খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ শীর্ষ নেতাদের সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য করা হতে পারে। তখন বিএনপির সুবিধাবাদীদের নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করবে সরকার। সরকারের এ কৌশল জানতে পেরেই দলের ঐক্যের প্রতীক জোবাইদাকে রাজনীতিতে নিয়ে আশার পরিকল্পনা করা হয়েছে। যেমনটি জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর দলের ভাঙন ঠেকাতে গৃহবধূ খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে নিয়ে আসা হয়েছিল।
এদিকে ১ অক্টোবর খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার কথা থাকলেও চিকিৎসকের পরামর্শে তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। তার দুই চোখেই অপারেশন করানোর জন্য পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি চোখে অপারেশন করাবেন। তবে দিনক্ষণ এখনো ঠিক হয়নি। যে কারণে দেশে ফেরা বিলম্ব হবে বলে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে।
ডা. জোবাইদা রহমান রাজনীতিতে এলে দলের জন্য মঙ্গল হবে মন্তব্য করে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, খালেদা জিয়া বাইরে থাকলে এ সরকার একটু হলেও নিরাপদ থাকবে। তিনি জেলে গেলে এই সরকারের দ্রুত পতন হবে। সেজন্য তাকে যেভাবে বন্দি বা গ্রেফতার করার চিন্তা করছে সেটা ঠিক হবে না।