হাইকোর্টের রায় : অপারেশন ক্লিনহার্ট দায়মুক্তি আইন অবৈধ

 

স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার আমলে অপারেশন ক্লিনহার্ট নামে পরিচালিত যৌথবাহিনীর অভিযানে হতাহতের ঘটনায় জড়িতদের দায়মুক্তি দিয়ে ২০০৩ সালে করা আইনকে অবৈধ ও বাতিল বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতনে মৃত্যু হত্যার জঘন্যতম রূপ। যৌথবাহিনী সংবিধানের ঊর্ধ্বে উঠে অভিযান পরিচালনা করেছে। আর এ ধরনের ঘটনাকে দায়মুক্তি দিয়ে জাতীয় সংসদকে আইন করার ক্ষমতা দেয়া হয়নি। তাই এ আইন শুরু থেকেই বাতিল। ধরে নিতে হবে এ আইনের জন্মই হয়েছে মৃতভাবে। তাই মৃত আইনের কোনো কার্যকারিতা থাকতে পারে না।

বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল এ রায় দেন। তবে এ অভিযানে নিহত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে একশ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠনের আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। এ বিষয়ে আদালত বলেছেন, ওই সময় ভিকটিম বা ভিকটিমের পরিবারের কোনো সদস্য প্রতিকার চেয়ে বা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারবেন। এমনকি ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট আবেদন করলে হাইকোর্ট এ বিষয়ে আদেশ দিতে পারবেন। উভয় বিচারপতি একমত হয়ে রায় দিলেও প্রত্যেকে আলাদা করে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।

আদালত পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অপরাধী ধরতে বা অপরাধ উদঘাটনে তদন্ত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু সংবিধান ও আইন এটা করার অনুমতি দেয়নি। অথচ অপারেশন ক্লিনহার্টে জিজ্ঞাসাবাদের নামে দরজা বন্ধ করে থার্ড ডিগ্রি মেথডসের মাধ্যমে নির্যাতন করা হয়েছে। আদালত বলেন, দুর্ধর্ষ অপরাধী হলেও তার আইনি প্রতিকার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কারণ আইনের চোখে সবাই সমান। সবারই আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজে আইন হাতে তুলে নিতে পারে না। তারা যেকোনো ব্যক্তির জীবন ও আইনগত সম্পদ রক্ষা করবে। সংবিধানে প্রদত্ত ব্যক্তি স্বাধীনতাকে বেআইনিভাবে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। আদালত জনগণের আশা-ভরসার আশ্রয়স্থল। আদালত অসচেতন হতে পারেন না। চোখ বন্ধ করে থাকতে পারেন না। তাই ওই আইনকে অসাংবিধানিক হিসেবে বাতিল ঘোষণা করছেন। এই রিট আবেদন জনস্বার্থে করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কোনো ব্যক্তি বা নিহতের পরিবারের কোনো সদস্য বা কোনো ভিকটিম এ আবেদন করেনি। তাই সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত কোনো ব্যক্তি আদালতে আবেদন করতে পারবেন।

আদালত পর্যবেক্ষণে আরো উল্লেখ করেছেন, এর আগেও দায়মুক্তি দিয়ে আইন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। অথচ এই অধ্যাদেশ চ্যালেঞ্জ করে কেউ আদালতে আসেননি। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এর চেয়ে আরো দুর্ভাগ্যজনক হলো ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে যে আইন করা হয় তা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করা হয়। এই প্রথম দায়মুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হলো। তাই আমাদের সামনে এ বিষয়ে আগের কোনো নজির নেই। সংবিধানের ৪৬ অনুচ্ছেদে দায়মুক্তি দিয়ে আইন করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে জাতীয় সংসদকে। এ দায়মুক্তির ব্যাখ্যা প্রয়োজন। কোনো হত্যাকারী কি দায় মুক্তি পেতে পারেন? কারো জীবনহানি হলে বা নির্যাতিত হলে বা সম্পদহানি হলে, অবিচার হলে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা দায়মুক্তি পেতে পারে না। দায়মুক্তি পেতে হলে আগে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে হবে যে সংঘটিত ঘটনা ইচ্ছাকৃত নয়। এটাই হচ্ছে সংবিধানে প্রদত্ত দায়মুক্তির চেতনা। এর বাইরে অন্য কোনো দায়মুক্তি আইনত হতে পারে না। আলোচ্য মামলায় যে দায়মুক্তির কথা বলা হচ্ছে তা সংবিধান বহির্ভূত। কারণ সংবিধানেই বলা হয়েছে, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন সংসদ করতে পারবে না। সংসদে প্রণীত কোনো আইনের যতোটুকু সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, ততোটুকুই বাতিলযোগ্য। আর এ কারণে ২০০৩ সালে প্রণীত যৌথবাহিনী দায়মুক্তি আইন বাতিল করা হলো।

অপারেশন ক্লিনহার্ট নামে পরিচালিত অভিযানের বৈধতা দিয়ে ২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে যৌথবাহিনীর অভিযান দায়মুক্তি আইন নামে একটি আইন করা হয়। এতে ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত পরিচালিত যৌথবাহিনীর অপারেশন ক্লিনহার্টে জড়িতদের দায়মুক্তি দেয়া হয়। এ অবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জেডআই খান পান্না আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১২ সালের ১৪ জুন একটি রিট আবেদন করেন। এ রিট আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে ওই বছরের ২৯ জুলাই হাইকোর্ট রুল জারি করেন। আইনটি কেন অসাংবিধানিক ও বাতিল ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়। একই সঙ্গে ওই অভিযানে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে একশ কোটি টাকার তহবিল গঠনের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়। এ রুলের শুনানি শেষে গতকাল রায় দেন হাইকোর্ট।

আদালতে রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন ড. শাহদীন মালিক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। রায়ের পর ড. শাহদীন মালিক সাংবাদিকদের বলেন, যৌথবাহিনীর বেআইনি কাজকে দায়মুক্তি দিয়ে তাদের আইনের ঊর্ধ্বে নেয়া হয়েছিলো। আদালতে এটা বাতিল করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আদালত তার পর্যবেক্ষণে নতুন একটি বিষয় তুলে এনেছেন। ক্ষতিপূরণ চেয়ে আগে রিট করা যেত না, আদালত এ বিষয়ে বলেছেন কেউ চাইলে ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট করতে পারবেন। আর হাইকোর্ট এ বিষয়ে আদেশ দিতে পারবেন।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে শুধু ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়ে বিরোধিতা করা হয়েছে। আমাদের বক্তব্য ছিলো, রাষ্ট্র কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে পারে না।