স্টাফ রিপোর্টার: কিডনি পাচার নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। কেননা কিডনি পাচার করা যায় না। তবে এই উদ্দেশে মানুষ পাচার করা যায়। এছাড়া কিডনি সংরক্ষণের কোনো প্রযুক্তিও আবিষ্কার হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্পষ্ট তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে গণমাধ্যমও সেটা ফলাও করে প্রচার করেছে। এটা বাংলাদেশের কিডনি প্রতিস্থাপনে সফলতায় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। এটা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ালে অনেকেই বিদেশে চলে যায় কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য। যেখানে সেখানে ও যত্রতত্র কিডনি ছুরিকাঁচি দিয়ে শরীর থেকে নেয়া যায় না। অপরদিকে এই কিডনি সংরক্ষণ করেও রাখা যায় না। আর কিডনি পাচারের নামে এ ধরনের বক্তব্য দেয়া অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ কিংবা এদেশের কিডনি প্রতিস্থাপন চিকিত্সা ব্যবস্থা বন্ধ করার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের উত্সাহিত করার সামিল বলে কিডনি বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেন।
প্রখ্যাত কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ এবং কিডনি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. হারুন-অর-রশিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, কিডনি পাচারকারী নিয়ে একটা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বিষয়টি সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভালো ধারণা নেই। মিডিয়াও একই ভুল করেছে। বাংলাদেশ কিডনি প্রতিস্থাপনে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে রয়েছে। কিডনি সংযোজনে মানুষ উত্সাহিত হচ্ছে। এই মুহূর্তে কিডনি পাচার সম্পর্কিত খবর প্রচারের কারণে রোগীরা বিদেশে যেতে উত্সাহিত হবে। এটা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং এতে বিদেশিরাও যুক্ত আছে।
তিনি বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপন করতে দুটি অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার লাগে। ডোনার এক টেবিলে এবং পাশের টেবিলে রোগীকে রাখতে হয়। লাগে ১০ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক দল। ৫ জন চিকিত্সক রোগীর কাছে এবং বাকি ৫ জন ডোনারের কাছে থাকে। পরে আলট্রা পারফিউশন ওয়াটার দিয়ে কিডনি পরিষ্কার করতে হয়।
৩০ মিনিটের মধ্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হয়। এই সময়ের বেশি কিডনি সংরক্ষণ করা যায় না। সময় অতিক্রান্ত হলে রক্তের কোষ মরে যায় এবং সেই কিডনি প্রতিস্থাপন করলে রোগী মারা যাবে। এছাড়া ডোনারের সাথে রোগীর রক্তের গ্রুপ, একই ধরনের টিস্যু টাইপিং ছাড়াও আনুষঙ্গিক নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিত্সকরা সিদ্ধান্ত নেন কিডনি প্রতিস্থাপনের উপযোগী কি-না। কিডনি প্রতিস্থাপন করতে ৬ ঘণ্টা সময় লাগে।
জানা যায়, বাংলাদেশে ২০১১ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক চক্র কিডনি পাচার সম্পর্কিত অপপ্রচার চালায়। তখন দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। চিকিত্সকদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়। সেই সময় জয়পুরহাটে এনজিও এবং কিছু ব্যাংক গরিব মানুষদের ঋণ দেয়। পরে টাকা ফেরত দিতে না পারলে এনজিও এবং ব্যাংক তাদের ঘরের চালা, গরুসহ সকল মালামাল নেয়া শুরু করে। পরে কিডনি দালালদের খপ্পরে পড়ে এসব সাধারণ মানুষ।
সে সময় দেশে কিডনি ও লিভার সংযোজন বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে করে বিত্তশালী কিডনি রোগীরা বিদেশমুখি হয় এবং গরিবরা বিপদে পড়ে যায়। পরে ২০১২ সালে সরকারি উদ্যোগে ফের কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা, বারডেমে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, কিডনি ফাউন্ডেশনে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা, সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজ অ্যান্ড ইউরোলজিস্ট হসপিটালে ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকায় কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। এছাড়া সরকারি পর্যায়ে শেরে বাংলা নগর জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। তবে পাশের দেশ ভারতে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে লাগে ১০-১৫ লাখ টাকা, সিঙ্গাপুরে ১ কোটি ২৫ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকা লাগে।
কিডনি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ইউরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. জামানুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, আইন অনুযায়ী কিডনি বেচাকেনার সুযোগ নেই। কেউ সেটা করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। তবে কিডনি দান করা যায়। সেটাও স্বামী-স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, পিতামাতা, চাচা-ভাতিজা এবং রক্তের সম্পর্কের কেউ কিডনি দান করতে পারবেন। অন্য কেউ পারবেন না। এছাড়া নাগরিক সনদও লাগে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিডনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. নিজাম উদ্দীন চৌধুরী বলেন, কিডনি পাচারের কোনো সুযোগ নেই। তবে মানুষ পাচার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কিংবা অন্য কোনো দেশে বিত্তশালী মানুষের কিডনি প্রয়োজন হলে দালালের দ্বারস্থ হয়। ২০-২৫ লাখ টাকার বিনিময়ে সেটা কেনা হয়। গরিব লোকদের নিয়ে যাওয়া হয় সেসব দেশে। পরে অপারেশন করে কিডনি প্রতিস্থাপনের পরে অল্প কিছু টাকা দিয়ে তাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়।