তাইতং পাড়ার রহস্যে ঘেরা সেই বাড়ি

স্টাফ রিপোর্টার: রাজস্থলীর তাইতং পাড়ার সেই বাড়িটি রহস্যে ঘেরা। তিনতলা বিশিষ্ট আধুনিক বাংলো বাড়িকে ঘিরে এখন সাধারণ মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। পাহাড়ি গহীন জঙ্গল এলাকায় এই সুন্দর বাড়িটি ছিলো মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির আশ্রয়স্থল। এখান থেকেই আরাকান আর্মির কার্যক্রম মনিটরিং করা হতো। বাড়ির চারদিকে সিসি ক্যামেরার পাশাপাশি আইপি ক্যামেরা (ইন্টারনেট প্রটোকল ক্যামেরা) রয়েছে। এ থেকে পুলিশ ধারণা করছে, আইপি ক্যামেরার মাধ্যমে এই বাড়ি থেকে আরাকান আর্মির সাথে ইন্টারনেটে যোগাযোগ হতো।

এদিকে রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলার তাইতং পাড়ার ওই বাড়ি থেকে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির সহযোগী সন্দেহে আটক অংনু ইয়ান রাখাইনকে গতকাল রাঙ্গামাটির আদালতে হাজির করার পর জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। গতকাল বিকালে রাঙ্গামাটি জেলা জজ আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলী আহসান তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। রাজস্থলী থানায় বিদেশি নাগরিক সম্পর্কিত আইনে একটি মামলা দায়েরের পর সকালে পুলিশ কড়া পাহারায় তাকে রাঙ্গামাটি জেলা জজ আদালতে হাজির করে। অন্যদিকে শুক্রবার সন্ধ্যায় পুলিশ ওই বাড়িতে আবারো অভিযান চালিয়ে দু কেয়ারটেকারকে আটক করেছে।

গতকাল ওই বাড়ির আশেপাশের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ঐ বাড়ির মালিক নেদারল্যান্ড প্রবাসী ডা. রেনাইজো। তার এ বিলাসবহুল বাড়িটি ছিলো আরাকান আর্মির আশ্রয়স্থল। আরাকান আর্মিদের কেউ অসুস্থ হলে ওই বাড়িতে রেখে চিকিত্সা সেবা প্রদান করা হতো। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, অংনু ইয়ান রাখাইন এক মাস আগে থেকে ওই বাড়িতে থাকা শুরু করেন। এর আগে বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে তার দু হাত উড়ে গেলে তাকে চট্টগ্রামে গোপনে চিকিত্সা দেয়া হয়। সুস্থ হওয়ার পর অংনু ওই বাড়িতে আসেন।

এ ব্যাপারে গ্রেফতার অংনু ইয়ান রাখাইন পুলিশকে জানিয়েছেন, সম্প্রতি তিনি আহত হওয়ার পর চট্টগ্রামের দুটি হাসপাতালে চিকিত্সা নেন। ওই বাংলো বাড়িতে আসার পর তিনি কখনই ঘর থেকে বের হতেন না। তাকে সময় মতো লোকজন খাবার দিয়ে যেতো। কিন্তু তাদের তিনি চিনেন না।

তাইতং পাড়ার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ১৯৯৬ সালে ডা. রেনাইজো ওই এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। এলাকায় তিনি একটি চেম্বার খুলে সাধারণ মানুষের সেবা দিতেন। এরপর থেকে তিনি স্থানীয় মানুষের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। ডা. রেনাইজো তাইতুং পাড়ায় বিয়ে করেন। ৫-৬ বছর আগে ডা. রেনাইজো বিলাসবহুল বাংলো নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এলাকায় তিনি দানবীর হিসাবে পরিচিত। যে কোন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি সাধ্যমত আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকেন। অনেক অনুষ্ঠানে তিনি নিজে উপস্থিত থাকেন।

ডা. রেনাইজো আরাকান আর্মির সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে তেমন কোনো তথ্যই স্থানীয় বাসিন্দারা জানেন না। তবে বিশাল বাংলো নির্মাণের পর সেখানে ১৫টি ঘোড়া থাকতো। বাংলোর পাশে ঘোড়ার আস্তাবলও নির্মাণ করা হয়। কিন্তু ২-৩ মাস আগে থেকে ১৫টি ঘোড়ার পরিবর্তে সেখানে দুটি ঘোড়া দেখতে পায় স্থানীয় বাসিন্দারা। বুধবার রাতে যৌথ বাহিনীর অভিযানের সময় ওই দু ঘোড়া জব্দ করা হয়। এছাড়া বড় মোদকে বিজিবির হাতে আটক ১৩ ঘোড়া আগে ওই বাংলোতে ছিলো বলে স্থানীয় বাসিন্দারা ধারণা করছেন।

রাজস্থলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন চৌধুরী জানান, রাজস্থলী উপজেলার এতো সুন্দরবাড়ি আর কারো নেই। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে ডা. রেনাইজো সম্পর্কে সেরকম তথ্য ছিলো না। ডা. রেনাইজো নেদারল্যান্ড প্রবাসী ছিলেন বলে তার বিলাসবহুল বাংলো থাকতে পারে বলে ধারণা ছিলো। তিনি গ্রামে দানবীর হিসাবেও পরিচিতি লাভ করেন খুব অল্প সময়ের মধ্যে। কিন্তু মঙ্গলবার সকালে বান্দরবানের থানচির বড় মোদকে ঘোড়া আটক হওয়ার পরই ওই বাংলোর ওপর বিশেষ নজরদারি শুরু হয়। এরপর যৌথবাহিনী ওই বাংলোতে অভিযান চালায়। বাংলো থেকে আরাকান আর্মির সহযোগী অংনু ইয়ানকে আটকের সময় বড় মোদকের সদৃশ আরো ২টি ঘোড়া জব্দ করা হয়। এছাড়া ওই বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস উদ্ধার করা হয়। এসবের মধ্যে আইপি ক্যামেরাও ছিলো। ওই বাড়িতে ইন্টারনেট প্রযুক্তিও ছিলো। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, সেখান থেকে আরাকান আর্মিদের সাথে যোগাযোগ হতো।

উল্লে­খ্য, গত ২৬ আগস্ট রাতে সেনাবাহিনী নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী তাইতুং পাড়ার ওই বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মিয়ানমারের নাগরিকসহ আরাকান আর্মির পোশাক-ল্যাপটপ, সিসি ক্যামেরা, আইপি ক্যামেরা, ই-ক্যামেরা ও ২টি ঘোড়া আটক করে।