করপোরেশনের ১ লাখ ৪১ হাজার টন চিনি অবিক্রিত : ৩৮ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হয় না

বেতনের বদলে চিনি : অবসর ভাতা বাবদ টাকা না পেয়ে কেউ কেউ বাধ্য হচ্ছেন চিনি নিতে

 

স্টাফ রিপোর্টার: চার দফা দাম কমিয়ে, প্রচার-প্রচারণা চালিয়েও চিনি বিক্রি করতে পারছে না সরকারি চিনিকলগুলো। ১৫টি সরকারি চিনিকলে এখনও অবিক্রিত আছে ১ লাখ ৪১ হাজার টন চিনি। যার আর্থিক মূল্য ৫২১ কোটি টাকা।

চিনি বিক্রি না হওয়ায় একই সাথে বিপাকে পড়ছে দর্শনার কেরুজ চিনিকলসহ নিজস্ব আয়ে চলা চিনিকলগুলোর কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকরা। চিনি বিক্রি করে অর্থসংস্থান করতে না পারায় ১৬ হাজারেরও বেশি জনবলের বেতনভাতায় অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো চিনিকলে দু-তিন মাস ধরে বেতন নেই। অনেক মিলে বেতনের পরিবর্তে দেয়া হচ্ছে চিনি। অনেকে অবসরে গিয়ে টাকা না পেয়ে চিনিকল থেকে নির্ধারিত দামে চিনি নিতে বাধ্য হচ্ছেন। দেশে চিনির চাহিদা বছরে ১৪ লাখ টন। এর মধ্যে ৯২ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। মাত্র ৮ শতাংশ চিনি উত্পাদন করে দেশীয় রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো। তারপরও রাষ্ট্রায়ত্ত কলের চিনি অবিক্রিত রয়ে যাচ্ছে। ১৯৭২  সাল থেকে এ করপোরেশনের লোকসান প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিনি বিক্রির আয় থেকে এতো লোকের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হয়। যার ফলে উত্পাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া আখ উত্পাদন থেকে শুরু করে প্রতি ক্ষেত্রেই হচ্ছে অনিয়ম, যাতে জড়িত রয়েছেন এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী। চিনিকলগুলোর নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) প্রধান কার্যালয়ে ২৫০ জনের জায়গায় জনবল রয়েছে ৩২৭ জন। চিনিকলগুলোতে নিয়মিত বেতন-ভাতা না হলেও হেড অফিসের কর্মকর্তারা নিয়মিত বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। মাঠ পর্যায়ের শ্রমিকের হতাশা থাকলেও হেড অফিসের কর্মকর্তাদের মধ্যে এর কোনো ছাপ নেই। কাজ না থাকায় অনেক কর্মকর্তা অলস সময় পার করছেন।

চিনিরকলে উত্পাদিত চিনি বিক্রি করার জন্য প্রায় ৫ হাজার ডিলার রয়েছে। তারা মিল থেকে চিনি বস্তা হিসেবে কিনে বাজারে বিক্রি করছেন। কিন্তু মিলগেটে আমদানিকৃত চিনির চেয়ে বেশি দামে কিনতে হয়। বেশি দামে কিনে বাজারে বিক্রি করতে গেলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কষ্টকর। আমদানিকৃত চিনির দাম কম হওয়ায় বাজারে বিক্রি হচ্ছে বেশি। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সুগার রিফাইন করে বেসরকারি উত্পাদকেরা খুচরা পর্যায়ে বাজারে চিনি বিক্রি করছে ৪০ টাকা কেজি দরে। আর দেশীয় চিনি ৪৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়। মিল গেটে চিনি বিক্রি হচ্ছে ৩৮ টাকায়। ঢাকা চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের গেটে ৪২ টাকায়। সরকারি মিলগুলোর চিনির রঙ লালচে থাকায় ক্রেতাদের আগ্রহ কম। এছাড়া সব দোকানেও এ চিনি পাওয়া যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোন ব্যবসায়ী কতো টন চিনি আমদানি করছেন, কতো মূল্যে আমদানি করছেন এবং বাজারে কতো মূল্যে তা সরবরাহ করছেন এ ব্যাপারে সরকারের জোরালো মনিটরিং নেই। এটা থাকা উচিত। তাতে চিনি নিয়ে কারসাজি থাকলে তা বন্ধ হবে। করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দেশীয় চিনিকলগুলো ধ্বংস করে দেয়ার জন্য চিনি আমদানিকারকরা ভর্তুকি দিয়ে চিনি বিক্রি করছেন। তারা বলছেন, দেশীয় চিনিকলগুলো বন্ধ হয়ে গেলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো চিনির দাম বাড়িয়ে দেবে।

এ শিল্পের প্রধান কাঁচামাল আখ। তবে চাহিদার তুলনায় এ জোগান এতোই কম যে, মরসুমের ৩-৪ মাস ছাড়া বছরের বাকি সময় মিলগুলোকে বসে থাকতে হয়। অথচ এ সময়ের পুরো বেতনই পরিশোধ করতে হয় শ্রমিক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। একদিকে দেশে উত্পাদিত আখের মান উন্নত না হওয়ায় অন্যদিকে চিনিকলগুলোর যন্ত্রপাতি বহু পুরনো হওয়ায় আখ থেকে চিনি পাওয়া যায় কম। ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ১২টি ৪০ থেকে ৮৩ বছরের পুরানো। মেরামত করে জোড়াতালি দিয়ে কোনরকমে চালানো হচ্ছে। আর প্রতি বছর মেরামত কাজে ব্যয় করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। পঞ্চগড় চিনিকলের অবস্থা খুবই শোচনীয়। অনেকে অবসরে গিয়ে টাকা না পেয়ে চিনিকল থেকে নির্ধারিত দামে চিনি নিতে বাধ্য হচ্ছে। পাবনা চিনি কলেও একই অবস্থা। অর্থের অভাবে বেতন বাবদ চিনি দেয়া হচ্ছে পাবনা সুগার মিলে। মিলের চিনি অবিক্রীত পড়ে থাকায় শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধে এ সিদ্ধান্ত চলছে। গত মরসুমে পঞ্চগড় চিনিকলে ৩ হাজার ৫১৮ টন চিনি উত্পাদিত হয়। সেই সাথে আগের দু মরসুমের ৬ হাজার টন চিনি অবিক্রীত ছিলো। বর্তমানে এ চিনিকলে এখনও ৮ হাজার ২০৩ দশমিক ১৫ টন চিনি অবিক্রীত রয়েছে। যার মূল্য ৩০ কোটি ৩৫ লাখ ১১ হাজার টাকা। চিনি বিক্রি না হওয়ায় শ্রমিক-কর্মচারীদের গত জুলাই মাসের বেতন এখনও দিতে পারেনি চিনিকল কর্তৃপক্ষ।

কুষ্টিয়া চিনিকলে ২৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকার অবিক্রিত চিনি গোডাউনে, তিন মাস বেতন নেই। অবিক্রিত এ চিনির মধ্যে ২ হাজার ৮১৭ টন গত মরসুমে উত্পাদিত চিনি। পঞ্চগড় চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম আব্দুর রশীদ বলেন, চিনি বিক্রয় না হওয়ায় শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন দিতে সমস্যা হচ্ছে। আমরা সরকারি দরের চেয়ে কম দামে চিনি বিক্রয় করতে পারি না। সরকার বিদেশ থেকে আমদানি করা চিনির ওপর শুল্ক আরোপ করলে এ সমস্যা আর থাকবে না।

জয়পুরহাট চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালাম বলেন, অবিক্রিত থাকা এ সব চিনি বিক্রি করা না গেলে আগামী নভেম্বর মাসে শুরু হতে যাওয়া মাড়াই মরসুমে চিনি রাখার জায়গা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে। গত মাড়াই মরসুমেও সাধারণ মিলনায়তন, স্কুল ঘর, অফিসার্স ক্লাবে চিনি রাখা হয়েছিলো। কুষ্টিয়া চিনিকলের ডিজিএম (উত্পাদন) গোলাম মর্তুজা জানান, কুষ্টিয়ার জগতি চিনিকলসহ দেশের প্রায় সকল চিনিকলই চরম সঙ্কটে পড়েছে। করপোরেশনে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার জন্য অনেকেই সচিবের অদক্ষতার চিত্র তুলে ধরেন। তবে করপোরেশনের সচিব এএসএম আবদার হোসেন চিনিকলগুলোর দুরবস্থার চিত্র এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, আমাদের পক্ষে লিখলে সব তথ্য দেবো।

Leave a comment