স্টাফ রিপোর্টার: মাঠ পর্যায়ের প্রচলিত তদন্ত কৌশল থেকে সরে গিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ায় অপরাধীদের শনাক্তে পুলিশ পিছিয়ে পড়ছে বলে মনে করছে বাহিনীটির সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তারা বলছেন, অতিমাত্রায় প্রযুক্তি নির্ভরতায় মাঠ পর্যায়ের সোর্স নষ্ট হচ্ছে; আর সে সুযোগই নিচ্ছে জঙ্গি ও ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা।
পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত বড় ধরনের যেকোনো অপরাধ সংঘটনের পর ক্ষতিগ্রস্তের মোবাইলফোনের কল লিস্টের সূত্র ধরে পুলিশের তদন্ত এগোয়। তবে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ঘটনার আগে ও পরে ঘটনাস্থলের আশেপাশে তথ্য আদান-প্রদানে খুনিরা মোবাইলফোন বা অন্য কোনো ধরনের প্রযুক্তির ধারে কাছেও ঘেঁষছে না। ফলে প্রযুক্তির ব্যবহার থাকলেও তা কাজে দিচ্ছে না তদন্তে।
২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মিরপুরের কালসীতে খুন হন ব্লগার রাজীব হায়দার। এটিই প্রথম কোনো ব্লগারকে হত্যার ঘটনা। এর দুই বছরের মাথায় হত্যা করা হয় লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে। সাড়ে পাঁচ মাসের ব্যবধানে একে একে খুন হন ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাস ও নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়। আর ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট খুন করা হয় টেলিভিশনে ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক নুরুল ইসলাম ফারুকীকে। ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর কথিত পীর লুৎফুল রহমান ফারুক ও তার ছেলেসহ ছয় জনকে বাসায় ঢুকে খুন করা হয়। সবগুলো হত্যাকাণ্ডের ধরন ছিলো একই রকম, ব্যবহার করা হয় চাপাতি ও ধারালো অস্ত্র।
এসব ঘটনার মধ্যে রাজীবকে খুনের সময় হত্যাকারীরা প্রযুক্তি ব্যবহার করায় এবং ওয়াশিকুরকে হত্যার পর হাতেনাতে দুজনকে ধরে ফেলায় কিছুটা সফলতা পায় পুলিশ। সাবেক আইজি নুরুল হুদা বলেন, অপরাধীরাও অনেকাংশে প্রযুক্তি নির্ভরশীল। তবে যারা অপরাধীকে ধরবে তাদের প্রিভেনটিভ ওয়ার্কটা ঠিকমতো হচ্ছে না। এজন্য তদন্তে দুর্বলতা থাকছে। মোবাইলফোন ট্র্যাক করে ব্লগার রাজীব হত্যায় জড়িতদের শনাক্ত করেছিলো পুলিশ।
পরে গ্রেফতার করা হয় নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় ছাত্র সাদমান ইয়াছির মাহমুদ, ফয়সাল বিন নাঈম দীপ, এহসান রেজা রুম্মান, মাকসুদুল হাসান অনিক, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজ। আলোচিত এই মামলাটি এখনো বিচারাধীন। এ ঘটনার মূল আসামি, যার বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে হত্যার ঘটনা ঘটছে সেই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানীও এখন কারাগারে। এসব হত্যাকারীরা মাঠ পর্যায়ে মোবাইলফোন ব্যবহার না করলে তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হতো কি-না সে ব্যাপারেও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন পুলিশের এক কর্মকর্তা।
ওই কর্মকর্তা জানান, ওয়াশিকুর রহমান হত্যার ঘটনায় পুলিশের তদন্তের প্রায় পুরোটাই কাজ করেছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনার পরপই জনতা জিকরুল্লাহ এবং আরিফুল নামে দুজনকে ধরে পুলিশে দেয়। যদিও এই হত্যার ঘটনার অন্তত ছয়দিন আগে পরিকল্পনায় জড়িত আবু তাহের ওরফে সাইফুল নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। পুলিশ চেকপোস্টে সাইফুলকে গ্রেফতার করা হলেও তখনো তারা জানতো না ওয়াশিকুর রহমান হত্যার পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম প্রধান সে। তবে হত্যাকাণ্ডের পর জনতার হাতে ধরা পরা দুজনের সাথে তাকে মুখোমুখি করা হলে পুলিশ পরিকল্পনার কথা জানতে পারে। এরপরই ওয়াশিকুর হত্যার ঘটনার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেয় সাইফুল।
পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওয়াশিকুরের হত্যাকারীরাও তথ্য আদান-প্রদানে মোবাইলফোন ব্যবহার করেনি। দুজন জনতার হাতে ধরা না পড়লে এই ঘটনাটিও এখন পর্যন্ত অন্ধকারে থেকে যেতো। এছাড়া অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ, নুরুল ইসলাম ফারুকী, লুৎফুল রহমান ফারুক এবং সর্বশেষ নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়ের হত্যাকারীদের কেউ মাঠ পর্যায়ে মোবাইলফোন ব্যবহার করেছেন এমন আলামত এখনো পাওয়া যায়নি বলে জানান ওই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, হত্যার কারণ ভিন্ন থাকলেও সবগুলো হত্যার ধরন একই রকম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেন, আমরা এ ধরনের সব ঘটনার পরই ভিকটিমের মোবাইলের কল লিস্ট খতিয়ে দেখি। এরপর দেখি তার সবচেয়ে কাছের মানুষের তালিকা। এ থেকেই ক্লু বের করে ফেলি। তবে মাঠ পর্যায়ে পুলিশের আগে যেরকম সোর্স ছিলো সেগুলো এখন আর নেই বললেই চলে। ফলে তদন্তে আমরা পিছিয়ে পড়ছি।
পুলিশের ওই কর্মকর্তার পরিচয় বক্তব্যের সূত্র ধরে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিলো গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার সাইফুল ইসলামের কাছে। তিনি বলেন, হত্যাকারীরা পরিকল্পনা করেই মাঠে নামে এবং পুলিশ কি প্রযুক্তি ব্যবহার করে তা তারা আগে থেকেই জানে। আর এটা এড়াতেই ঘটনার আগে ও পরে তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করছে না।