স্টাফ রিপোর্টার: ৯ বছর বয়সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলো কক্সবাজারের মেয়ে নাসিমা আক্তার। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে অষ্টাদশী এখন নিজের জগত খুঁজে নিয়েছেন সার্ফিং খেলায়। সার্ফিংয়ের প্রতি অদম্য ভালোবাসা তার। আর এ ক্ষেত্রে তাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে নানা সামাজিক রক্ষণশীলতা ও প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু কোনো কিছু দমিয়ে রাখতে পারেনি তাকে। বাংলাদেশে সার্ফিং খেলায় নারীদের পথিকৃত তিনি। চার বছর আগে মার্কিন সাংবাদিক জয়মাল ইয়োগিসের এক প্রতিবেদনে প্রথম উঠে আসে নাসিমার গল্প। এরপর তার গল্পে অনুপ্রাণিত হন ক্যালিফোর্নিয়ার প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা হিথার কেসিঞ্জার। সিদ্ধান্ত নেন নাসিমার গল্প তুলে ধরবেন তার প্রামাণ্যচিত্রে। নাসিমাকে নিয়ে তৈরি প্রামাণ্যচিত্রটির নাম রাখা হয়েছে দ্য মোস্ট ফিয়ারলেস। শিগগিরই তা মুক্তি পাবে চলচিত্র উৎসবে। ইতিমধ্যে মোস্ট-ফিয়ারলেস নাসিমাকে নিয়ে প্রতিবেদন এসেছে ব্রিটেনের সানডে টাইমস, অস্ট্রেলিয়ার দ্য অস্ট্রেলিয়ানে। এছাড়া নারী বিষয়ক আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন ম্যারি ক্লেয়ারেও এসেছে সচিত্র প্রতিবেদন। ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে তার। নাসিমা যে শুধু সার্ফিং ভালোবাসে তাই নয়, এতে সে দারুণ দক্ষ। পানিতে নামার জন্য কটূক্তি শুনতে হয়েছে তাকে। কিন্তু সার্ফিংয়ের প্রতি অদম্য আগ্রহ এগিয়ে নিয়ে গেছে তাকে। হিথার কেসিঞ্জারের প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে নাসিমার লড়াই। উঠে এসেছে হৃদয়ছোঁয়া এক অনুপ্রেরণার গল্প। কেসিঞ্জার বলেন, তার গল্প বলার মাধ্যমে সে সব মেয়েদের একইভাবে তাদের গল্প তুলে ধরার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাকে ভেঙে দিয়েছেন। নাসিমার সরল অভিব্যক্তি- আমার স্বামী ও পরিবার সার্ফিং পছন্দ করে না। বাংলাদেশি কোনো মেয়ে সার্ফিং করবে এটা তারা পছন্দ করে না। কিন্তু আমার সার্ফিং অসম্ভব ভালো লাগে। কেসিঞ্জার নাসিমাকে নিয়ে বলেন, নাসিমা একজন ভালো মুসলিম স্ত্রী হতে চায়। সে চায় তার সম্প্রদায়ের একজন সম্মানিত অংশ হতে। কিন্তু এজন্য সার্ফিংয়ের প্রতি তার তীব্র অনুরাগ ছাড়তে সে সম্পূর্ণ নারাজ। ব্রিটেনের পত্রিকা দ্য সানডে টাইমসে বাংলাদেশি সার্ফার গার্ল সিঙ্কস মুসলিম ট্যাবুজ শিরোনামে নাসিমাকে নিয়ে বলা হয়, নাসিমা বাংলাদেশের একজন সার্ফার। এ কিশোরী বাংলাদেশের রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের প্রচলিত প্রথা ভেঙে মেয়েদের সার্ফিং শেখাচ্ছেন। সমাজের ভয় ভেঙে বেরিয়ে আসার জন্য তাদের অনুপ্রেরণা, উৎসাহ যুগিয়েছেন। বিভিন্ন সার্ফিং প্রতিযোগিতায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন নিয়মিত। আর, একের পর এক পুরুষ প্রতিযোগীদের হারিয়েছেন সার্ফিংয়ে। নাসিমার সাথে মার্কিন সাংবাদিক জয়মাল ইয়োগিসের পরিচয় ৪ বছর আগে। তিনি বলছিলেন, বাইরে বেরিয়ে তাদের পছন্দের কাজ করার সাহস যুগিয়েছে নাসিমা। ভ্রমণবিষয়ক একটি ম্যাগাজিনে ইয়োগিস নাসিমার ওপর একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। দ্য মোস্ট ফিয়ারলেস- প্রামাণ্যচিত্রে উঠে এসেছে, মাত্র ৯ বছর বয়সে বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় নাসিমা। এরপর একটি সার্ফ ক্লাবে নিজের পরিবার খুঁজে পান তিনি। বাংলাদেশ সার্ফ ক্লাব নামের এ সংগঠনটির পৃষ্ঠপোষক একটি মার্কিন ক্রিশ্চিয়ান সংগঠন। নাসিমার পাশাপাশি এখন ক্লাবে আরও অনেক নারী সার্ফার রয়েছেন। তিনিই তাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছেন। প্রত্যেককেই নানা প্রতিকূলতার মধ্য যেতে হয়েছে। নাসিমাও মানুষের বিদ্রূপ ও নানা প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে এগিয়ে গেছেন। যখনই নাসিমা সমুদ্র সৈকতে গেছেন, আশপাশের লোকজন তাকে বেশ্যা বলে কটূক্তি করেছে। বাংলাদেশ এখনও সার্ফিংয়ে একেবারেই নতুন। নাসিমা শুধু এ খেলার প্রতি তার অদম্য অনুরাগ নিয়ে এগিয়ে চলেছেন তা নয়, বাংলাদেশে নতুন এ খেলাটিকে জনপ্রিয় করে তুলতেও রয়েছে তার ভূমিকা। নাসিমাকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের নামকরণ দ্য মোস্ট ফিয়ারলেস করার কারণ ব্যাখ্যা করলেন ইয়োগিস। তিনি বললেন, তার মধ্যে যেমন ছিলো চারিত্রিক ঔজ্জ্বল্য, পাশাপাশি ছিলো কষ্ট সহ্য করার অসম্ভব ক্ষমতা। সে কারণেই শেষ পর্যন্ত আমরা চলচ্চিত্রের নাম দ্য মোস্ট ফিয়ারলেস রাখলাম।
নানা সার্ফিং প্রতিযোগিতায় জেতা অর্থ জীবন নির্বাহ করতে নাসিমাকে সাহায্য করেছে। তারপরও শুধু সেই অর্থ যথেষ্ট ছিলো না। তাই শামুক-ঝিনুকের খোলস সংগ্রহ করে সেগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে হয় তাকে। কখনও কখনও সৈকতে উল্টো করে শুইয়ে রাখা নৌকার তলায় ঘুমিয়ে রাত কাটাতে হতো তাকে। নাসিমা আক্তার শুধু বাংলাদেশে নারীদের সার্ফিয়ের সূচনার পথিকৃৎ নন, তিনি কক্সবাজারের লাইফসেইভিং অ্যান্ড সার্ফিং ক্লাবে বাংলাদেশের প্রথম নারী লাইফগার্ড বা প্রাণ রক্ষাকারী ব্যক্তির প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এতো অর্জন আর সাফল্য সত্ত্বেও, সমাজের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া নিয়ে সংগ্রাম করতে হচ্ছে নাসিমাকে। ১৬ বছর বয়সে যে তরুণের সাথে তার বিয়ে হয়, তিনিও এটা মেনে নিতে পারেন না। সমাজের মানুষ বিষয়টাকে মোটেও ভাল চোখে দেখছে না বলে নাসিমাকে সতর্ক করেন স্বামী। প্রামাণ্যচিত্রে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
কেসিঞ্জার ২ বছর আগে প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণের কাজে হাত দেন। সে সময় নাসিমাই ছিলো বঙ্গোপসাগরের বুকে দাপিয়ে বেড়ানো একমাত্র কিশোরী। সে সংখ্যা পরে ক্রমেই দীর্ঘায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে। গত বছর ১০ থেকে ১৩ বছর বয়সী ৮ জন সার্ফিং ক্লাবে ভর্তি হয়। এই তরুণী সার্ফারদেরকেও ডকুমেন্টারিতে দেখানো হয়েছে। নাসিমার সংগ্রাম ও সাফল্যগাথা তাদের ভিন্নভাবে ভাবতে অনুপ্রাণিত করবে এবং তাদের স্বপ্নের পথে এগোতে সাহায্য করবে। কেসিঞ্জার এমনটাই মনে করেন। বাংলাদেশের একটি মোবাইলফোন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে তাদের মধ্যে একজনের স্থান করে নেয়াটাকে সমাজের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ইঙ্গিত বলেই মনে করা হচ্ছে। কেসিঞ্জার বলছিলেন, জীবনে বহু সংগ্রামের পথ পেরিয়েও নাসিমা হাল ছাড়তে আগ্রহী নন এবং তিনি অন্য মেয়েদের জন্য পথ তৈরি করে দিয়েছেন। তিনি বলছিলেন, যেকোনো স্থানের পথিকৃৎদের কথা ভাবুন। কখনও কখনও তারা নিজের কাজের স্বীকৃতি পান এবং সমাজ তাদের বুঝতে পারে, কখনও হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম তাদের চিনতে পারে। তিনি বললেন, নাসিমার গল্প এখনও শেষ হয়নি। ম্যারি ক্লেয়ার ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাসিমা একাধারে একজন পথিকৃত, প্রতিকূলতা উত্তরণকারী আর এখন একজন রোল-মডেল।